, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

করোনাভাইরাস: আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রয়োজনীয় কিছু উদ্যোগ

  সমাজ

  প্রকাশ : 

করোনাভাইরাস: আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রয়োজনীয় কিছু উদ্যোগ

রয়টার্স ফাইল ছবি।


করোনাভাইরাস নিয়ে এখন আলোচনা সর্বত্র। পশুপাখি বা স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। চীনের বাইরে আরও ১৩টি দেশে ইতিমধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে কোনো আক্রান্তের খবর এখনো পাওয়া যায়নি। নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পৃথিবীতে তিন হাজারের অধিক করোনাভাইরাস রয়েছে। এ ভাইরাসে মৃত্যুর হার প্রায় ৩ শতাংশ, তবে ঠান্ডার কারণে মৃত্যুর হার কিছুটা বেড়েছে।

আমরা বছরজুড়ে জ্বর ও সর্দি–কাশিতে ভুগে থাকি। বাড়িতে বাড়িতে যেন থাকে জ্বরের তাণ্ডব। এগুলো শুধু ইনফ্লুয়েঞ্জা নাকি অন্য কোনো ভাইরাস দ্বারা হচ্ছে, তা আমাদের জানা নেই। ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম (বিশ্বে প্রায় ৪ লাখ মানুষ প্রতিবছর মারা যায়), তবে প্রতিকূল আবহাওয়া ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বয়স (শিশু ও বৃদ্ধ) এবং চিকিৎসাহীনতার কারণে এ মৃত্যুর হার বেড়ে যায়, যেটি করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষেধক (টিকা) না থাকায় এটি সাধারণ জ্বরের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার
বিষয়টি উদ্বেগের এবং আশঙ্কার। এ ভাইরাস দেহে প্রবেশ থেকে লক্ষণ প্রকাশ বা শরীর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত সময়কাল সাধারণত ২-৫ দিন, তবে ক্ষেত্রবিশেষে ১৪ দিন পর্যন্ত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি লক্ষণ প্রকাশের আগেও জীবাণু ছড়াতে পারে।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও বন্য প্রাণীর পরিবেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ, অবৈজ্ঞানিকভাবে গৃহে পশুপালন ও ভক্ষণ মানবসম্প্রদায়কে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নতুন এই করোনাভাইরাসসহ সার্স, মার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি। চীনাদের খাদ্যাভ্যাস এসব রোগে আক্রান্তের কারণ। সরীসৃপ, ব্যাঙ, শূকর, বেজি, বনবিড়াল, খাটাশ, শিয়াল, ইঁদুর—এসব প্রাণী প্রকৃতিতে অনেক রোগজীবাণু বহন করে। এগুলোকে যখন গৃহে পালন করা হয় বা ভক্ষণ করা হয়, তখন তারা মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখির মধ্যে সহজেই রোগজীবাণু ছড়িয়ে থাকে। প্রাথমিকভাবে এসব প্রাণী থেকে কোনো ভাইরাস মানুষ বা গৃহপালিত পশুপাখিতে প্রবেশ করে বংশবিস্তার করতে না পারলেও পরবর্তী সময়ে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয় এবং বংশবিস্তার শুরু করে রোগ সৃষ্টি করে।

মাছ ও পশুপাখির নাড়িভুঁড়ি বা উচ্ছিষ্ট অংশ রোগজীবাণুর বড় উৎস। অথচ কসাইখানা বা মাংস ও মাছ বিক্রির জায়গাগুলোতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এগুলো ফেলে রাখা হয়, যা কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, খাটাশ, ইঁদুরসহ বিভিন্ন মাংসাশী প্রাণী এগুলো খেয়ে জীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারে। এসব প্রাণীর বর্জ্য ড্রেন বা পয়োনিষ্কাশনের মাধ্যমে বা বৃষ্টির পানিতে গড়িয়ে পুকুর, ডোবা, নালা ও খেতখামারে চলে যেতে পারে। যেগুলো থেকে পরবর্তী সময়ে মানুষ, পশুপাখি, মাছ বা সাপে সংক্রমিত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্কভুক্ত দেশগুলো বাদুড়সহ অন্যান্য বন্য প্রাণী ও মশাবাহিত রোগবালাইয়ের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অধিক জনসংখ্যা, খাদ্যাভ্যাস, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, প্রাণীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, বন্য প্রাণীর প্রকৃতি ও পরিবেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ, খোলাবাজারে হাঁস-মুরগি ও প্রাণী বিক্রি এবং মশার প্রজনন পরিবেশ ঝুঁকির প্রধান কারণ বলে বিবেচিত।

অনেক ভাইরাস বাদুড়ের শরীরে রোগ সৃষ্টি ছাড়াই বসবাস করে, অর্থাৎ বাদুড় বিভিন্ন ভাইরাসের আধার হিসেবে কাজ করে। নিপাহ, ইবোলা, সার্স, মার্স, জলাতঙ্কসহ অনেক ভাইরাস বাদুড় থেকে অন্য প্রাণী বা মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে। বাদুড়ের খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, চলাচল ও জৈবিক অবস্থা অনেক ক্ষেত্রে এর জন্য দায়ী। এ ছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে বাদুড়ের প্রজনন বেড়ে যাওয়া ও বন উজাড় বা তাদের অভয়ারণ্য কমে যাওয়া, মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখির বিচরণের জায়গায় তাদের বিচরণও বেড়েছে, ফলে বাদুড়বাহিত রোগজীবাণুর সংক্রমণও বাড়ছে।

শুধু সার্স বা করোনাভাইরাস নয়, মানবদেহের রোগবালাইয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে পশুপাখি ও জলজ প্রাণী থেকে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাংস প্রক্রিয়াকরণ ও বিক্রি, ক্রেতাদের সতেজ বা তাজা মাংসের প্রতি আগ্রহ, প্রাণীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বা সংস্পর্শ নতুন নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এসব প্রাণীর সংরক্ষণ, উৎপাদন ও ভক্ষণে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে-সেখানে খোলাভাবে গবাদি পশুপাখি জবাই ও বিক্রির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। মলমূত্র বা বিষ্ঠা নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। খোলাবাজারে মাছ ও মাংস বিক্রির জায়গাগুলো বৈজ্ঞানিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশের হাটবাজারগুলোতে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও তদারকি থাকা প্রয়োজন। সরকারের আধুনিক স্লটার হাউস বা কসাইখানা তৈরির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে যেকোনো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাই আমাদের সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

চীনে ভ্রমণ আপাতত নিয়ন্ত্রিত রাখা উচিত এবং চীন থেকে আসা যাত্রীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা এবং মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ভ্রমণের সময় যাত্রীদের সাধারণ স্বাস্থ্য ঘোষণাপত্র সরবরাহ করে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার বসিয়ে যাত্রীদের মনিটরিং করার কথা বলা হলেও গবেষণায় দেখা গেছে, থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে একটি দেশে ভাইরাল ফিভারের কোনো ব্যক্তিকে সঠিকভাবে শনাক্তকরণ এবং প্রবেশে বাধা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তাই সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আলাদা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে আরটি পিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে ইমিউনোলজিক্যাল কিট ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়। আমাদের দেশে তা করা হচ্ছে কি না, সে রকম কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসেনি। তা না করে শুধু থার্মাল স্ক্যান করে নিশ্চিত বলা যাবে না। সমস্যা চিহ্নিত হলে তা অবহেলা না করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই উত্তম। ব্যক্তিগত সুরক্ষা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারে এসব ভাইরাস থেকে। মাস্ক ব্যবহার, করমর্দন না করা, দিনে কয়েকবার হাত–মুখ ধোয়া—এসব বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে বা নিয়ন্ত্রণের পূর্বশর্ত হলো সঠিক সময়ে রিপোর্টিং করা, গুরুত্বসহকারে বিষয়টি আমলে নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করা, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সে অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

ড. মো. সহিদুজ্জামান: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
szaman@bau.edu.bd

  • সর্বশেষ - আলোচিত খবর