আমার মাঝেইতো বাবা থাকেন
প্রকাশ :
সাইদুল ইসলাম
বাবা, গত কদিন থেকে তোমার কথা কেন জানি খুব বেশি মনে পড়ছে। তোমাকে হারানোর পর দশটা বছর কতটা শূন্যতা, কতটা হাহাকার বুকে নিয়ে চলি তা হয়তো কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না। কিন্তু গত কয়েকদিন তোমার কথা, তোমার ছায়া, তোমার ছবি অনেক বেশি মনে পড়ছে বাবা। চারদিকে এত আতঙ্ক, হাকাকার, দুশ্চিন্তা আর মানুষের কষ্টের ছবি আমার কিছুটা অবসর সময়কে আরও বেশি ভারি করে তুলছে। আজকাল বাবার বয়সী কাউকে কষ্টে দেখলেই তোমার ছবিটা চোখে ভাসে। বুঝি, তুমি কতটা কষ্ট করেছো জীবনের প্রতিটা দিন।
তোমার মাঝবয়সী জীবন সংগ্রামে যখন তুমি গলদঘর্ম তখন শুরু হলো দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম। হানাদারদের বেয়নেট খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলেছে তোমার ৩২টা দাঁত। রাইফেলের বাটের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে তোমার মুখ। তবু তোমার মুখ থেকে বেরোয়নি একটি প্রশ্নের জবাব, মুক্তি কাঁহাহে?
দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু জীবনের সীমাহীন কষ্ট থেকে তোমার স্বাধীনতা মেলে না। চলতে থাকে আমাদের অনেক ভাই-বোনের সংসার চালাতে তোমার নিত্যসংগ্রাম। আমাদের পেটে আহার জোগাতে কতদিন তোমার পেট থেকেছে অনাহারে জানি না। কখনও বাড়ির ধূসর মাঠে ফসল ফলানোর সংগ্রাম, কখনও আরেকটু ভালো থাকার আশায় ছোট-খাটো ব্যবসা।
ক্লান্ত শরীরেই কতদিন ছুটেছো এক জেলা থেকে আরেক জেলা, এক মোকাম থেকে আরেক মোকাম। কত রাত তোমার কেটেছে ট্রেনের মালগাড়িতে, ট্রাকচালকের পাশের সিটে কিংবা গরুর গাড়ির বাঁশের মাচালে, তা হিসাব করা যাবে না। আমি তখন ছোট। কিন্তু অনেক কিছু মনে আছে বাবা। তখন সেসব কষ্ট দেখেও বুঝতে পারিনি। এখন না দেখেও সেসব ছবি প্রতিদিন আমাকে কাঁদায়।
আমরা ভাই-বোনরা বড় হতে থাকি। তোমার সংগ্রাম যেন আরও বাড়তে থাকে। এত সংগ্রাম, এত কষ্ট, এত এত না পাওয়া তারপরও তোমার মুখে শুনিনি কোনো অসৎপথে, মিথ্যা বলে কারও কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেয়ার কথা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় রাজনীতিতে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তার সাথে তোমার সম্পর্ক ছিল অনেকটার বন্ধুর মতো। শত কষ্টেও সেই সম্পর্কটাকে তুমি ব্যবহার করোনি। এখনকার সময়ে হলে কেউ হয়তো কোটি কোটি টাকার সুবিধা নিয়ে নিতো।
তুমি সে সময় নিজেকে একটু ছোট করলে তোমার আর্থিক অবস্থাটা হয়তো আরেকটু বড় হতো। কিন্তু নিজেকে ছোট করোনি তুমি। এখন বুঝি সেটা কত বড় কাজ। শত কষ্টেও নিজেকে ধরে রাখা, নিজের ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখা কঠিন কাজ। সেটি তুমি করেছো নিজের শত কষ্টকে মেনে নিয়ে। আজ যখন সেসব কথা মনে করি তখন বুকটা গর্বে ভরে যায় বাবা। তাই নিজেকে ধরে রাখতে, নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে অনেক বেশি সাহস পাই। নিজের সততা আর ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখতে তুমি যে কষ্ট করছো তার একভাগও আমাকে করতে হয়নি। তাহলে আমি কেন তোমার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবো বাবা?
প্রতিদিন তোমার কাছে কত মানুষ আসতো কত রকমের অভাব অভিযোগ নিয়ে। হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না কোনো। আমাদের সংসারের এত কষ্টের মধ্যেও দেখেছি কত মানুষকে তোমার সহায়তার হাতটি বাড়িয়ে দিতে। কারও বিরুদ্ধে কারও অভিযোগ আসলে শুনিনি কাউকে একটা অসৎ পরামর্শ দিতে। গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে ভেঙে যাওয়া গ্রামের বিরাট সমাজটাকে আবার এক করেছিল তোমার প্রচেষ্টা।
মানুষের কথা ভেবে তুমি নির্বাচন করতে ইউনিয়নে। কখনও পাস কখনও ফেল। কিন্তু তোমার কাছে মানুষের চাওয়া-পাওয়া, অভাব-অভিযোগের সমাধান ছিল একইরকম। আমরা ভাই-বোনরা রাগ করতাম তোমার নির্বাচন নিয়ে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর পক্ষে ছিলাম না আমরা। কিন্তু তুমি শোনোনি। শেষে মেনে নিতাম।
তোমার শেষজীবনে আমাদের ভাই-বোনদের চেষ্টায় সংসার অনেকটা ভালোই চলছিল। সেটা তুমি নিজ চোখে দেখে যেতে পেরেছো। সততাকে ধরে রেখে, পরিশ্রম করেই আমরা চেষ্টা করেছি নিজেদের ভাগ্য বদলাতে। আল্লাহ তোমার দোয়া কবুল করেছে। আমাদের অনেক ধন-সম্পদ হয়নি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে অল্প সম্পদেও আল্লাহ আমাদের ভালোই রেখেছেন।
তোমার জীবনের শেষ দুটি বছর কেটেছে শারীরিক কষ্টে। আমরা চেষ্টা করেছি তোমার সেই কষ্টকে আমাদের মাঝে ভাগ করে নিতে। একটা মাছিও যাতে তোমাকে কষ্ট না দেয় সেটা ছিল আমাদের ভাই-বোনদের চেষ্টা। তারপরও আমাদের কোনো ঘাটতি থাকলে আমাদের ক্ষমা করো বাবা।
বাবা, জানি যতদিন বেঁচে থাকব তোমার শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হবে না। কিন্তু সেই শূন্যতাকে পূরণ করতে আমার চেষ্টা, আমাদের চেষ্টা তোমার সততার আদর্শকে লালন করা। কষ্টের মধ্যে থাকলেও অন্যের কষ্টে হাত বাড়িয়ে দেয়া। কারও ক্ষতির চিন্তা মাথায় না আনা। তোমার সন্তানরা এখনও সেই রাস্তায় আছে। ভবিষ্যতেও সেই রাস্তাতেই থাকতে চাই।
বাবা, আমি যখন স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতাম, কোথাও বেড়াতে যেতাম, যখন বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম, তোমার কাছে গেলে তোমার হাতটা আমার মাথায় রেখে দোয়া করে দিতে। আজ দশ বছর আমার মাথায় কেউ সেই হাতটি রাখেনি বাবা…………
রব্বির হাম হুমা, কামা রব্বা ইয়ানি সগিরা…
বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবা-মা।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, জিটিভি।