, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

প্রেয়সী

  নিজস্ব প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

প্রেয়সী

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। শ্রাবণের ধারায় টিনের চালে এক দারুণ শব্দ তৈরি করছে। বারান্দায় বসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছি। হাতে চায়ের পেয়ালা থাকলে বেশ জমে উঠতো পরিবেশ। শুধু পেয়ালা নয়; পাশে গল্প করার মতো মনের মানুষ পেলে রোমান্টিক আবহে বাড়তি মাত্রা যোগ হতো।


ফেসবুকে ঢুকে কিছু পোস্ট ইতোমধ্যে পেয়ে গেলাম বর্ষাকে উপজীব্য করে। অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে নিজের ভাবাবেগ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমন একটি প্লাটফর্ম, যেখানে একাকিত্বের কোন সুযোগ নেই। বিশাল বন্ধুসমাবেশ বলা যায়। প্রিয়জনের দূরত্বও ঘুচে যায় প্রযুক্তির স্পর্শে।


মেসেঞ্জারে পরিচিত কয়েকজনের আনাগোনা দেখা গেল। তাদের সাথে আমার নিয়মিত গল্প-আড্ডা হয়। তবে এমন মোহনীয় বৃষ্টিস্নাত আবহে আমাকে এসব টানছে না। বৃষ্টির পানিতে ভিজে স্নান করার বাসনা জেগে উঠছে মনে। যদিও আমার সে বাসনায় প্রেয়সীর অনুপস্থিতি ভীষণ পীড়া দিচ্ছে।


বাড়ির সামনে উঠানে বাতাবি লেবু গাছে শোভা পাচ্ছে বড় বড় লেবু, লেবু চুইয়ে পড়া পানি অসাধারণ এক নান্দনিক দৃশ্যের অবতারণা করছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি গাছের ভেজা পাতার সজিবতা মনকে সজিব করে তুলছে। উঠান পেরিয়ে সামনে রাস্তা, মাঝে মধ্যে ভীষণ গতিতে গাড়ি চলছে, সে শব্দ মায়াবি আবহে ছেদ টানলেও তার মুগ্ধতা কম নয়!


নাগরিক ব্যস্ততায় বাংলার ঋতুবৈচিত্র উপভোগ যেমন হয়ে ওঠে না; তেমনি শহুরে জীবন, গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্যময় নান্দনিক আবহ থেকে আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতির পাতায় নানা দৃশ্য, শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় আবহ ফুটে উঠতেই চমকে উঠছি নিজের অজান্তে।


কয়েক বছর পর নিজ আঙিনায় একদম গ্রামীণ আবহে বসে আছি। মাটির গন্ধ যেমন পাচ্ছি; তেমনি রয়েছে ফল-ফুলের সুবাস। নিজের মনকে আন্দোলিত করতে এর চেয়ে সুন্দর আবহ আর কী হতে পারে!


শৈশবে বৃষ্টির মাদকতায় বন্ধুরা মিলে ডিঙ্গি নৌকায় করে শাপলা ফুল তুলেছি, মাছ ধরার বাসনায় বিলে বিচরণ ছিল এক জীবন্ত দৃশ্য। সময়ের সাথে সাথে গ্রামীণ জীবন-যাত্রায়ও পরিবর্তন এসেছে। সব কিছু এক নতুন আবহে সময়ের ফ্রেম খুঁজে নিয়েছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বে এমন বাস্তবতা নিশ্চয়ই মেনে নিতে হবে।


ইতোমধ্যে আমার জন্য গরম চা এসেছে। বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার ছাড়া আর লোকবল নেই। আমি মাঝে মধ্যে এলে সে আমাকে যত্ন করে দেখভাল করে। রাকিব এলাকারই ছেলে। বিয়ে করেনি কোনদিন। ফলে তার সংসার করা হয়ে ওঠেনি। আমাদের বাড়িতেই তার বেড়ে ওঠা। এখানেই তার বসবাস। বিয়ে না করার একটা কারণও তার আছে। থাক সে কথা। রাকিবের চা বানানোর হাত প্রশংসনীয়। এলাকার সুধী সমাজে সে প্রশংসা কুড়িয়েছে। হালকা গরম লাল রঙের চায়ে একটু মশলা দিয়ে সামনে আনতেই চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার প্রলোভন সামলে উঠতে পারলাম না।


বৃষ্টি মুষলধারে পড়ছে, টিনের শব্দ আর মাটির গন্ধ সব মিলিয়ে মোহনীয় আবেশে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভীষণ স্বর্গীয় অনুভূতি বোধ করছি।


আমার বেড়ে ওঠা গ্রামেই। উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় পাড়ি জমানো। তবে শহুরে জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে সুযোগ পেলে নিজের শেকড়ের সন্ধানে ছুটে আসতে মন চায় ভীষণ রকম। বৃষ্টির সাথে প্রেয়সীর এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শিল্পীর রং তুলি, কবির কবিতা কিংবা লেখকের গল্পে সে চরিত্রের শক্ত অবস্থান প্রমাণ করে। বৃষ্টিস্নাত দিনে একাকী নিরবে বসে কল্পরাজ্যে বিচরণে প্রেয়সী হবে সঙ্গিনী।


প্রেম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। যৌবনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করে। আগুনের শিখার মত বার্ধক্যে জ্বলে অনেকের মনে ক্ষত তৈরি করে। প্রেমের প্রাপ্তি তৃপ্তি এনে দিলেও বিফলতা অমর করে দেয়। আপনার প্রেয়সীর অমরত্ব তাকে না পাওয়ায় নিহীত থাকে।


আমার সাথে অন্নির সম্পর্ক যখন সময়ের সাথে সাথে গভীরতা পেল; তখন নিজেকে বড় সফল মনে হতে লাগলো। মেয়েটি দেখতে উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের হলেও তার চোখের মায়াবী আবহ আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করতো। কথা বলার মাধুর্য আর আমার প্রতি তার বিশ্বাস দু’জনের মধ্যে ভীষণ আবেগের সঞ্চার করলো। মূলত আমরা দু’জন একই কলেজে পড়ি। ভালো বন্ধুত্ব থেকে আমাদের প্রেমের জয়রথে যাত্রা।


অন্নির সাথে গল্প করতে করতে কলেজ থেকে ফেরা কিংবা বিকালে তার বাড়িতে শিক্ষকের লেকচার মেলাতে যাওয়া- সবই মনে ভীষণ দুর্বলতার সঞ্চার করতো। দারুণ মায়ারী সে। আমাদের ভালোবাসার কথা দু’জনের কেউ কাউকে না বললেও আমরা কেন জানি দু’জন পরস্পরকে ভালোবাসি। সে অব্যক্ত ভালোবাসা চোখের ভাষায় প্রকাশ পেতো। দু’জনেই আমরা লাজুক। তবে আমাদের বোঝাপড়া ছিল ভীষণ রকম।


প্রথমবর্ষে কোন একদিন দুপুরে ক্লাস শেষে আমরা বাড়ির দিকে ফিরছি। হালকা মেঘলা আকাশ, শ্রাবণের প্রথম দিকে হবে হয়তো সময়টি। আমরা দু’জনে হেঁটে পথ চলেছি। আসলে কলেজ থেকে অন্নির বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় আমরা হেঁটে গল্প করতে করতে আসতাম। সময়টাও আমাদের দারুণ পার হতো। সেদিন পথিমধ্যে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। অন্নির ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে সে আমাকে তার ছাতার নিচে ডাকলো। আমরা রাস্তা ধরে হাঁটছি, হালকা বাতাস আমাদের কিছুটা ভিজিয়ে দিলো।


অন্নিকে গোলাপি রঙের জামায় যতটা সুন্দর লাগছে তার চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে ভেজা আবহে। দু’জনেই কিছুটা ভিজে ভিজে হাঁটছি। রাস্তার দু’পাশে কিছু বাবলা গাছ রয়েছে। গাছের দু’পাশে ফসলের মাঠ আর নিরব-নিস্তব্ধ আবহে তার হাত ধরে কাছাকাছি হাটার রোমান্টিক আবহ ভীষণ আন্দোলিত করলো। কিছুটা জড়িয়ে তার ঠোঁটে স্পর্শের সে দিনের মাদকতা আমাকে আজও ভীষণ তাড়িত করে। ছাতা দিয়ে বই-খাতা বাঁচিয়ে দু’জনে অনেকটা ভিজে বৃষ্টির সাথে মিতালি করে বাড়িতে ফেরা হলো। তার ভেজা চুলের মাদকতা ভীষণ রকম আন্দোলিত করলো আমায়।


অন্নির সাথে এরপরও আমার বৃষ্টিতে ভেজার সুযোগে হয়েছে। তবে প্রথম দিনের মাদকতা, তার ভেজা সৌন্দর্য আমাকে আজও মুগ্ধ করে চলেছে। স্মৃতির পাতায় সে সময় আজও অম্লান হয়ে আছে।


অন্নির বাবা সরকারি চাকরি করতেন। অন্নি দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় তারা সপরিবারে মেহেরপুর চলে যান। কলেজ পরিবর্তন করে সেখানে এক কলেজে অন্নিকে ভর্তি করান। এরপর মাঝে মধ্যে আমাদের মোবাইলে যোগাযোগ হতো। এইচএসসি পরীক্ষা শেষে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে ঢাকা যাওয়ার পর কোন এক অজানা কারণে তাকে হারিয়ে ফেলি। আমি খোঁজ নিয়েছি, এখনো নিয়ে চলেছি। তবে আজও তার সন্ধান পাইনি। তাদের বাড়িতে তার বাবা আর ফিরে আসেননি। শুনেছি এলাকার জায়গা-জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে পারিবারিক কলহের কারণে যোগাযোগ নেই। হয়তো বা তারা আর কোনদিন এলাকায় ফিরবেন না।


রাকিব প্রেয়সীকে হারিয়ে একাকী জীবন-যাপন বেছে নিয়েছে। তার মনে সোনালীর স্মৃতির বসবাস। ফলে সে আর বিয়ে করেনি। তবে আমার ক্ষেত্রে এমনটি নয়। আমি সদ্য নতুন চাকরি পেয়েছি। কিছুদিন পর হয়তো আত্মীয়-স্বজন বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধান করবে। নিজের অমতে সমাজ রক্ষার্থে আমাকে সংসার পাততে হবে। মনের বিরুদ্ধে সে জীবন সুখ এনে দিতে সক্ষম কি-না আমি জানি না। তবে নিশ্চয়ই তা সমাজ রক্ষা করতে সক্ষম। হাজার বছর ধরে চলমান জীবনের নিয়মিত বাস্তবতা আমিও হয়তো মেনে নেব। কিন্তু মনের কুটিরে অন্নির অস্তিত্ব নিশ্চয়ই স্বমহিমায় বিরাজমান থাকবে।


বৃষ্টির ফোটা আমার মনে বিঁধে চলবে যুগ যুগ। তাকে না পাওয়ার অতৃপ্তিতে হয়তো বা আমার মনে তার অমরত্ব রচিত হবে। সময়ের আবহে তা বয়ে চলবে বৃষ্টির স্রোতধারা হয়ে।

  • সর্বশেষ - সাহিত্য