, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

মৃত নয় জীবিত, বাবা নয় চাচা

মৃত নয় জীবিত, বাবা নয় চাচা

দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখেই কাটছিল শাহজাহান আর বেলী বেগম দম্পতির সংসার। একটি দুর্ঘটনা তছনছ করে দিয়েছে তাদের সুখের সংসার। সাত বছরের শিশুসন্তান বুলবুলি আর মা বেলী সড়ক দুর্ঘটনায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ময়মনসিংহ-শেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে ফুলপুরের ছনধরা ইউনিয়নের বাশাটি গ্রামে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে শিশুসহ আটজন নিহত  হন। এ দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও শিশুসন্তানকে হারিয়েছেন ভালুকা উপজেলার বিরুনিয়া ইউনিয়নের বাকশিবাড়ি গ্রামের শাহজাহান (৪০)। স্ত্রী-সন্তান, ভাই ও আত্মীয়দের নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায় খালাতো ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন তিনি। নিজের প্রাণ বাঁচলেও স্ত্রী ও আদরের শিশুসন্তানকে হারিয়েছেন তিনি।

তবে এই দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ভাইরাল হয়। যেটি সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ছবির দৃশ্য সবাইকে কান্নায় ভাসিয়ে দেয়। বাবা শাহজাহান ও মেয়ে বুলবুলি ভেবে হৃদয়স্পর্শী ছবিটি শেয়ার করেন অনেকেই। কেউ কেউ বলেছেন বাবা-মেয়ে দুইজনের মারা গেছেন। এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন অনেকে।

এ অবস্থায় অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভাইরাল হওয়া ছবিটি বাবা-মেয়ের নয়। ছবিটি চাচা-ভাতিজির। তবে বুলবুলি মারা গেলেও তার বাবা শাহজাহান জীবিত আছেন। তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুলবুলির চাচা শারফুলের (৩৬) কোনো সন্তান নেই। এজন্য ভাই শাহজাহানের মেয়ে বুলবুলিকে নিজের মেয়ের মতো আদর-যত্ন করতেন চাচা শারফুল। নালিতাবাড়ী উপজেলায় খালাতো ভাইয়ের জানাজায় অংশ নিতে যাচ্ছিলেন তিনিও। একই গাড়িতে ছিলেন তারা সবাই।

দুর্ঘটনার পর জীবিত অবস্থায় ফিরে দেখেন আদরের ভাতিজিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। লাশ দেখেই আহাজারি শুরু করেন তিনি। বুলবুলির লাশ বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। এই কান্নার দৃশ্য সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। দৃশ্য দেখে সবাই মনে ভেবেছিলেন বাবা-মেয়ে। পরে জানা গেল চাচা-ভাতিজি।

jagonews24

চাচা শারফুলের কোলে ভাতিজি বুলবুলি

এদিকে, চাচা-ভাতিজির হৃদয়স্পর্শী ছবি ‘বাবা-মেয়ের’ বলে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আটজনের মধ্যে বাবা-মেয়েও আছেন বলা হয়। মূলত এই তথ্য সঠিক নয়।

পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ফুলপুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে এক পরিবারের তিনজনসহ আটজন নিহত হয়েছেন। ময়মনসিংহ-শেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে ফুলপুরের ছনধরা ইউনিয়নের বাশাটি গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসে ১৪ জন যাত্রী ছিলেন। তারা ভালুকা, তারাকান্দা ও গফরগাঁও উপজেলার বাসিন্দা।

নিহতরা হলেন- ভালুকা উপজেলার বিরুনিয়া ইউনিয়নের বাকশিবাড়ি গ্রামের শাহজাহানের স্ত্রী বেলী বেগম (৩০), তাদের শিশুসন্তান বুলবুলি আক্তার (৭), শাহজাহানের মা মিলুয়ারা বেগম (৫৫), গফরগাঁও উপজেলার রিপা খাতুন (৩০), শামছুল হক (৬৫), রেজিনা খাতুন (৫৩), পারুল আক্তার (৫০) এবং তারাকান্দা উপজেলার নবী হোসেন (৩০)।

মাইক্রোবাসে থাকা বাকি ছয়জন বেঁচে গেছেন। তারা হলেন- নিহত বুলবুলির বাবা শাহজাহান, চাচা শারফুল, আত্মীয় মিজান (২৮), রাজু (২৭), গফরগাঁও উপজেলার হাবীব ৫৫) ও রতন (৫৫)।

বুলবুলির চাচা শারফুল বলেন, অতি আদরের ভাতিজিকে মৃত অবস্থায় দেখে আমি নির্বাক হয়ে যাই। আমার কোনো সন্তান নেই। বুলবুলি আমার সন্তানের মতো। আমি কখনও বুলবুলিকে ভাতিজি মনে করিনি, নিজের মেয়েই মনে করতাম। সবসময় নিজের মেয়ের মতো আদর-যত্ন করেছি। বুলবুলির লাশ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি; তাই বুকে জড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম। আমার ভাই হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছেন। আমার ভাই জীবিত অথচ তাকে ফেসবুকে মৃত বানিয়ে দিয়েছে। বুলবুলিকে হারানোর শোকে ভাই স্তব্ধ। এর মধ্যে ছড়ানো হলো মৃত্যুর গুজব।

ভালুকা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি খাদেমুল বাশার বলেন, শাহজাহানের সংসারের সবার আদরের সন্তান বুলবুলি। মেয়ে আর স্ত্রীকে হারিয়ে শাহজাহান স্তব্ধ হয়ে আছেন। কালকে এই সময় যাদের চোখের সামনে দেখেছিলেন আজ তারা দুনিয়ায় নেই। এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শাহজাহানের গ্রামে শোকের ছায়া নেমেছে। আমাদের কারও মন ভালো নেই। এ অবস্থায় মৃত বুলবুলির জীবিত বাবাকে মৃত বানিয়ে ফেলা হলো। চাচাকে বানানো হলো বাবা। তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ছবি এবং কোনো কিছুই শেয়ার করা ঠিক না। না জেনে মন্তব্য করা তো মস্ত বড় ভুল। মাগরিবের পর জানাজা শেষে পারিবারিক গোরস্থানে বুলবুলি ও তার মাকে দাফন করা হয়েছে।

ফুলপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমারত হোসেন গাজী বলেন, শারফুলের খালাতো ভাইয়ের জানাজায় নালিতাবাড়ী উপজেলায় যাচ্ছিলেন সবাই। পথিমধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে আটজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন শিশু, পাঁচজন নারী ও দুইজন পুরুষ। এদের মধ্যে মা-মেয়ে ও দাদিসহ এক পরিবারের তিনজন। স্বজনদের কাছে তাদের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।

ময়মনসিংহের সহকারী পুলিশ সুপার (ফুলপুর-সার্কেল) দীপক চন্দ্র মজুমদার বলেন, মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা। মাইক্রোবাসের চালক এখনও পলাতক। তাকে গ্রেফতার করা হবে।

  • সর্বশেষ - মহানগর