মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?
প্রকাশ :
আসমাউল মুত্তাকিন
‘এ আর নতুন কী? মৃত্যুর পর সবাই আফসোস করে। হয়তো আমাকে নিয়েও করবে। মৃত্যুই বোধহয় মুক্তি!’- গত ১১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন পোস্ট করে আত্মহত্যা করেন পার্বতীপুরের ভবানীপুর ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সমাপ্ত হাসান। বয়স কত হবে! ১৯ বছরে পা দিয়েছিল। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিল সমাপ্ত। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র পুলিশিং কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিল। তার এ কর্মকাণ্ডে এলাকার মানুষ খুশি হয়েছিল। কিন্তু তার এভাবে চলে যাওয়ায় পরিবার, আত্মীয়-স্বজন কেউ মানতে পারছিল না।
এতো গেল সমাপ্তের কথা। শুধু সমাপ্তই নয়। এভাবে জীবনের মায়া ছেড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। প্রতিদিনের জাতীয় দৈনিক পত্রিকা বা অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুললে এমন অনেক নিউজ আমাদের চোখে পড়ে। তাদের এমন মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন স্বজনরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেন্টিং সুইসাইড: অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’ জরিপ বলছে, ‘প্রতিবছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি।’ আরও একটি জরিপ বলছে, ‘গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা।
এতো গেল বিশ্বের কথা। এবার বলি বাংলাদেশের কথা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) দেশে আত্মহত্যার ঘটনার তথ্য রাখে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। আর ২০১৭ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৬ জন। বছর শেষে এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করছেন। যাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি।
ইতালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস এক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘আত্মহত্যা করার জন্য কারো কারণের অভাব হয় না।’ তাত্ত্বিকরা এ কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। তাই গড়ে উঠেছে একাধিক তত্ত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান ড. মো. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি হলো- মানসিক চাপ। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। চাপটা বেশি হয়ে গেলে কারো কারো মনে হয়, তিনি আর সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সহজ মনে হয়।’ (সূত্র: সমকাল)
তিনি আরও বলেন, ‘বিষণ্নতায় যারা ভোগেন, তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। কারণ জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। ছেলেবেলা থেকে যাদের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করে।’
এক গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে আগেই অন্যের কাছে (বন্ধু-বান্ধব) কম-বেশি তথ্য দেয়। সেসব তথ্য গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মার্কিন লেখক অ্যাডওয়ার্ড ডালবার্গ বলেন, ‘যখন কেউ উপলব্ধি করে, তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। তখন সে আত্মহত্যা করে নতুবা ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ে। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো মানুষের জীবনই মূল্যহীন বা অর্থহীন হতে পারে না। তথাপি কেউ যদি তা মনে করেন, আমি চাইব, আত্মহত্যার পরিবর্তে তিনি ভ্রমণকেই বেছে নেবেন।’
তাই আসুন, নিজের জীবনকে উপভোগ করি। নিজে সচেতন হই, অপরকেও সচেতন হতে সাহায্য করি। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেই। তাছাড়া আরেকটি উপায় হলো- একাকিত্ব ভালো না লাগলে ভ্রমণে বের হয়ে পড়ি। কে জানে, হয়তো ঘুরতে ঘুরতেই তিনি খুঁজে পাবেন জীবনের অর্থ! আত্মহত্যা করার সুযোগ তখন আর থাকবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।