, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

আয়নায় দেখি মুখোশের মুখ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

আয়নায় দেখি মুখোশের মুখ

পৃথিবীটা অদ্ভুত। অনেক কিছুই মানুষ পারে। কিন্তু নিজের মুখটা নিজে দেখতে পারে না। একটা কাচের আয়নায় মানুষ তাকে দেখে। কতটা অসহায়, বিপন্ন মানুষ, যারা নিজেরা নিজেদের দেখতে পায় না। আবার এ দেখাটা বাইরের, ভেতরের নয়। আয়নার বাইরের মানুষ আর ভেতরের মানুষের মুখটা কি অভিন্ন, নাকি সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রিক আরেকটি অজানা সত্তা, সেটা মুখ নাকি মুখোশ? হয়তো চেনার মধ্যেও অচেনার একটা সন্দেহ মানুষের মধ্যে থেকে যায়। কিংবা নিজেকে জানার ও বোঝার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান মানুষের মনুষ্যত্বে মরচে পড়ে, ঝাপসা হয়ে যায় আত্মপরিচয়, শিকড়কে আঁকড়ে ধরা শক্ত মাটি। যতই মানুষ নিজেকে লুকাক না কেন, যদি অন্তর্দৃষ্টি থাকে তবে বাইরের সঙ্গে ভেতরের মুখটাও মানুষ দেখতে পায়। যদি সেখানে বিবেকতাড়িত মানবিক মূল্যবোধ থাকে। বিশুদ্ধ মন থাকে। উদার দৃষ্টিভঙ্গি, সার্বজনীন চিন্তা ও জীবনবোধ থাকে। দর্শন, মনস্তত্ত্ব ও বিজ্ঞান থাকে। লৌকিকতা কিংবা অলৌকিকত্ব থাকে। বাস্তবতা ও কল্পনার মেলবন্ধন থাকে। স্বপ্ন, বিশ্বাস আর লক্ষ্য থাকে।

নিজের মুখটা কী রকম দেখতে তা জানাই যেত না যদি আয়না আবিষ্কার না হতো। পানির মধ্যে নিজের ছায়া দেখে মানুষ প্রথম জানতে পারে সে কেমন দেখতে। তারপর নানা চিন্তা-ভাবনা করতে করতে তারা একদিন আয়না আবিষ্কার করে ফেলে। এ আয়নার একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে। প্রায় ২০০ বছর আগে ‘জাস্টিস ভন লাইবিগ’ নামে একজন জার্মান রসায়নবিদ স্বচ্ছ কাচের এক পাশে টিন ও পারদের এক ধরনের প্রলেপ দেয়ার একটি কৌশল আবিষ্কার করেন। এ কৌশলটিই পরবর্তী সময়ে আয়না আবিষ্কারের মৌলিক ধারণা হিসেবে কাজ করেছে।

ইংরেজ কবি ও লেখক জিওফ্রে চসারের লেখা ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’ গল্পে আছে- টারটারির রাজা কাম্বুস্কানের একটি বিস্ময়কর আয়না ছিল, সেই আয়না দেখে তিনি আগে থেকেই বলে দিতে পারতেন ভবিষ্যতে কী ঘটবে। ‘রেনার্ড দ্য ফক্স’ রূপকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘রেনার্ড’ ছিল একটি শিয়াল। এ শেয়ালটির এমন এক ধরনের আয়না ছিল, যেটা দিয়ে সে এক মাইল দূরের বস্তু দেখতে পেত। আইরিশ সাহিত্যিক অলিভার গোল্ডস্মিথ তার গল্পে এক ভিন্নমাত্রিক চীন দেশের আয়নার কথা বর্ণনা করেছেন। এ আয়নার মাধ্যমে যে কোনো মানুষের মন ও সে ঠিক সেই মুহূর্তে কী ভাবছে তা বোঝা যায়। হয়তো আমাদের আয়নায় মানুষের মনের ভেতর কী কাজ করছে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে ভেতরের সত্তাকে বের করে আনতে পারেন। বাইর ও ভেতরে মানুষ যাতে সর্বাঙ্গীণ মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারে সেজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক আচরণগত ধারণাগুলোকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বাড়ানোর কৌশল প্রয়োগ করে মানুষের চিন্তার জগৎকে প্রভাবিত করা যায়। মানুষের মধ্যে ইতিবাচক আচরণগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এ সুপ্ত আচরণগুলো বের করে আনার জন্য মানুষে মানুষে মানবিক সম্পর্ক, সম্প্রীতির মনোভাব, একে অন্যকে সহযোগিতা করার আগ্রহ, সততা ও উদারতার মতো বিষয়গুলোকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের অনুসর্গ হিসেবে প্রয়োগ করার জন্য সরকার জাতীয় মানবিক নীতিমালা গ্রহণ করতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থাকলেও মানবিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য কোনো ধরনের মন্ত্রণালয় এখনও পর্যন্ত গঠন করা হয়নি; কিন্তু আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখার জন্য মানবিক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।

কথিত আছে, জাপানিরা অপরাধীদের অপরাধ শনাক্ত করতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের মুখের সামনে আয়না ধরে রাখেন। সত্য কিংবা মিথ্যা কথা বলার সময় মুখের যে পরিবর্তন হতো তা তারা আয়নার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করত। অপরাধের প্রকৃতি ও তা প্রতিরোধের বিষয়টি নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞানীরা গবেষণার কাজ করতে পারেন। সেখান থেকে অর্জিত ফলাফল সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিমালার সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।

বেশ কয়েকজন গবেষক সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম পোট্রেট বা মুখোশ। ইসরাইল থেকে তারা প্রায় ৯ হাজার বছর পুরনো বেশ কয়েকটি মুখোশের সন্ধান পেয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে, পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এগুলোই সর্বাধিক প্রাচীন মানুষের তৈরি মুখোশ। ইসরাইলের জুদেন পাহাড় থেকে পাওয়া মুখোশগুলোর চোখ বেশ বড় বড়। পাথরের কাঠামোতে নির্মিত এ মুখোশগুলোর একেকটির ওজন প্রায় দুই কেজি। মুখোশগুলোর দেহের বিভিন্ন অংশে রঙের প্রলেপ দেয়া আছে। যদিও দীর্ঘ সময়ের কারণে এ মুখোশগুলোতে এখন আর রং নেই, তবে রঙের উপস্থিতি বোঝা যায়।

নিওলিথিক যুগে কেন মানুষ মুখোশের ব্যবহার করেছিল তা বলা কঠিন। তবে ছেঁড়া সুতার অস্তিত্বের মাধ্যমে এ রহস্যের দুটি সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করা হয়েছে। প্রথমত, প্রকৃতিতে থাকা জন্তু-পশুদের ভয় দেখানোর জন্য মানুষকে মুখোশের আশ্রয় নিতে হয়েছিল; দ্বিতীয়ত, সেই সমাজে পুরোহিতরা সমাজে আধিপত্য বা ডাকিনিবিদ্যার বিপরীতে ক্ষমতার আধার হিসেবে মুখোশ সৃষ্টি করেছিল। এ মুখোশগুলো যাদের হাতে তৈরি তারাই সম্ভবত যাযাবর জীবনের ধারণা ত্যাগ করে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল; কিন্তু এখনও এর প্রকৃত ইতিহাসের বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। আমরা মুখোশের মানুষ চাই না। বরং অভিন্ন সত্তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন বহুমাত্রিক ধারণার মানুষ চাই।

মানুষের মধ্যে এখন কেমোফ্লাজের বিষয়টি কাজ করছে। মানুষ নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে তার প্রকৃত সত্তার বদলে ভিন্ন সত্তাকে ধারণ করেছে। নিজেকে আড়ালে রেখে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। এটাই কেমোফ্লাজ। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের কৌশল যুদ্ধক্ষেত্রে অবলম্বন করেন। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হঠাৎ করে লুকিয়ে যাওয়া, আশপাশে যা কিছু আছে তার সঙ্গেই মিলিয়ে যাওয়া, অস্ত্রগুলো হুটহাট লুকিয়ে ফেলা বা যে কোনো উপায়েই নিজেদের স্বাভাবিক দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়াটাই কেমোফ্লাজ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এ মিলিটারি কেমোফ্লাজের কৌশল খুব রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। যেটা ছিল যুদ্ধের কৌশল।

আজ সেটা হয়ে উঠেছে অপরাধীদের কৌশল। বড় বড় অপরাধীরা এ কৌশল গ্রহণ করার ফলে তাদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অপরাধীদের বেশিরভাগ মানুষ হচ্ছে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অংশ, ভাবতে অবাক লাগছে। মানুষের ভেতর আর বাইরের মধ্যে বিশাল ব্যবধান। মুখে এক কথা, বিশ্বাসে আরেক ভাবনা। কে আপন, কে পর আজকের এ সময়ে এসে চেনাটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে মানুষ চেনা। কারণ কে সত্য বলছে, আর কে অভিনয় করছে, সেটা বোঝা শুধু কঠিন নয়, দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে।

‘কনফার্মেশন বায়াস’-এর প্রবণতা মানুষের মধ্যে ক্রমাগত বাড়ছে। যুক্তি আর নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মানুষ নিজে যা বিশ্বাস করছে তার পক্ষে প্রমাণ দাঁড় করাচ্ছে। হয়তো সে প্রমাণের কোনো ভিত্তি নেই। তারপরও নিজের বিশ্বাসের দ্বারা মানুষ অন্যের ব্যক্তিত্ব ও বিশ্বাসকে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কীভাবে অবৈধ অর্থ দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্বকে কেনা যায় তার কৌশল গ্রহণ করেছে। অসৎ মানুষ তাদের অশুভ শক্তির প্রভাব বলয় বাড়াতে মানুষদের অসৎ করার পরিকল্পনায় সফল হচ্ছে। সততার শক্তিকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা চলছে সুকৌশলে। একজন বা দু’জন সৎ মানুষ যদি বৃত্তের বিন্দু হয় তবে তাদের ঘিরে রেখেছে অসাধু মানুষ। সততার বিশ্বাস অসত্যের সংখ্যাধিক্যে নিষ্পেষিত হচ্ছে। ‘কনফার্মেশন বায়াসে’র মাধ্যমে মানুষ দুর্নীতিকে তার অধিকারের অংশ বলে ভাবতে শুরু করেছে ও এর পক্ষে একটার পর একটা যুক্তি এনে তা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। সততাকে যুক্তিহীন করে অসততার যুক্তিকে পোক্ত করছে।

সাধারণত দার্শনিকরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্তি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন ধারণার জন্ম দেন। কিংবা কোনো একটি প্রতিষ্ঠিত মৌলিক ও ফলিত বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের সৃষ্টিশীল নতুন ভাবনার গোড়াপত্তন ঘটান। জার্মান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ হ্যানা এরেন্ট এদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি দর্শনগত জ্ঞান থেকে বলতেন, প্রত্যেকটি জ্ঞাত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যই অস্বীকার করা যায়।

দর্শনগত ধারণাটি এসময়ে এসে খুব যুক্তিপূর্ণ মনে হচ্ছে। যেমন অনেকদিন ধরেই সমাজে অর্থ আর ক্ষমতার নেতিবাচক ব্যবহারের ফলে এখন মানুষ এগুলোকে ব্যক্তির শক্তির উৎস বা মর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করছে। এর ফলে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ও প্রতিভাধর মানুষের কদর কমছে। যে ইতিবাচক আচরণ ও অবস্থানকে আগে মানুষ মর্যাদার জায়গায় চিন্তা করত, সেখানে অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি জায়গা করে নেয়ায় মানুষের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। প্রকৃতিগত সত্যের জায়গায় কৃত্রিম ধারণা দৃশ্যমান হয়েছে। এটি বলার কারণ হচ্ছে, মানুষ এ ধরনের অনেক ভ্রান্ত ধারণাকে এখন সত্য বলে মেনে নিয়েছে কিংবা মানতে বাধ্য হয়েছে। এখন সময় এসেছে প্রকৃত সত্যের পুনর্বাসনের।

একজন মানুষের মধ্যে দুই ধরনের সত্তা থাকতে পারে। যখন একটি স্বতন্ত্র জীবের মাঝে দুটি আলাদা জিনের সেট থাকে, দুই চোখের রং দুই রকম হয়, দুই রকমের রং শরীরে দেখা যায়, শরীরে দুই ধরনের ইমুনিটি সিস্টেম একইসঙ্গে কাজ করে, তখন এ অবস্থার উদ্ভব ঘটে। বিজ্ঞান এটাকে বলছে কাইমেরিজম। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ব্যক্তিকে বলা হয় কাইমেরা বা কাইমেরিক। সবার ক্ষেত্রে এটি ঘটার কথা নয়। খুব ব্যতিক্রমী একটি বিষয় এটি; কিন্তু এখন মানুষের ভেতর আর বাইরটা এক নেই। বাইরে আনুগত্য আর ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতা। বাইরে সত্যের উন্মাদনা, ভেতরে মিথ্যের পরিকল্পনা। কোথাও মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরে উদারতা ভেতরে সংকীর্ণতা। বিবেকের আয়নায় মানুষ দেখছি না, মানুষের পরিবর্তে দেখছি ইটপাথরে গড়া কৃত্রিম মানুষ। এখান থেকেই আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে, তা না হলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভেঙে পড়বে সমাজব্যবস্থা।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

  • সর্বশেষ - অতিথি কলাম