2024-04-20 07:27:56 am

একজন অপরিচিত তরুণী ও আমি

www.focusbd24.com

একজন অপরিচিত তরুণী ও আমি

২৪ নভেম্বার ২০২০, ২২:৪৯ মিঃ

একজন অপরিচিত তরুণী ও আমি

জাহিদুল ইসলাম

সিত্তুল মুনা হাসান ম্যামের ‘সার্টেন্টি অ্যান্ড দ্য সেলফ প্রেজেন্টিং’ টপিকসের ওপর একটানা দুই ঘণ্টার ক্লাস শেষ করে রুম থেকে নিশ্চুপে বের হই। কলা ভবনের পঞ্চম তলা থেকে টুকটুক করে নিচে নামতে শুরু করি। সামনে কাঁঠালতলার দিকে অগ্রসর হলাম। মসজিদের সামনে বকুলের মিষ্টি গন্ধ আর ক্যান্টিনের পাশে কাঠবাদাম গাছটায় লাল পাতাগুলো ঝরে পড়ছে। উদ্দেশ্য ছিল টিএসসি গিয়ে মঈন মামার এক কাপ করা লিকারের চা খাবো।

চারিদিকে তখন অন্ধকার। ঠান্ডা একটা বাতাস আমার ভেতরটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বাতাসের বেগ বাড়লো। শুরু হলো ধুলিঝড়। আমি এক দৌড়ে ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচে চলে গেলাম। একটু পরই ঝুম বৃষ্টি নামলো। ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করে খুলে মাথায় দিলাম। বাংলা ভবনের বাইরে পা রাখবো, এমন সময় পেছন থেকে সুরেলা একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পেলাম- ‘জাহিদ!’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। সাদা শাড়ি পরা, চুলে গোঁজা কাঠগোলাপ, মাঝারি উচ্চতার, ধবধবে ফর্সা এক হরিণচোখী অচেনা তরুণী আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। ভাবলাম, হয়তো কোনো বন্ধুর বন্ধু হতে পারে, না হয় আমারই কোনো বান্ধবী। যার ব্যাপারে এ মুহূর্তে কোনো তথ্য মাথায় আসছে না।
কোমল কণ্ঠে বললাম, ‘আমাদের কি আগে দেখা হয়েছিল?’
- বাস্তবে একবারও না। ক্যানভাসে আপনার লেখা মাঝে মাঝে পাই। সেই সূত্রে দু’একবার আপনার প্রোফাইল ঘাঁটা হয়েছে।
-যাক, লেখালেখির সিদ্ধান্তটা মনে হয় ভুল ছিল না।
- মেবি! আচ্ছা, একটা অনুরোধ। হুম, টিএসসি পর্যন্ত আপনার ছাতার নিচে যাওয়া যাবে?
- তবে চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। হাজার হোক, আপনি আমার লেখার একজন পাঠক।

মেয়েটি এখন আমার ছাতার নিচে। মেয়েটির চুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। ছাতার নিচে গুটিসুটি পায়ে আমরা হেঁটে চলেছি। গায়ে গা যাতে না লাগে এর জন্য নিজের শরীরের অর্ধেক ছাতার বাইরে বের করে রেখেছি। এখনো মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইনি, জানতে ইচ্ছেও করছিল না। তবে মেয়েটিকে চমকে দিতে ইচ্ছে করছিল। কারণ আমার পুরোনো পাগলামির রোগটা ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।

হঠাৎ মেয়েটিকে বললাম, ‘আপনি ছাতাটা নিয়ে চলে যান। আমি আপাতত এই তুমুল বৃষ্টির আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারছি না। আমি এখন ভিজতে ভিজতে শান্ত চত্বরে গিয়ে বসবো। তারপর একদৃষ্টিতে বৃষ্টি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো।’
মেয়েটি মনে হয় কিঞ্চিত অবাক হলো। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
- আপনি আসলেই এখন ভিজতে ভিজতে চলে যাবেন?
- আমার মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে আমাকে যা করতে বলে, আমি সেটাই করি।
- কিন্তু আপনার ছাতা!
- ক্যাম্পাস বেশি বড় না। পরে খুঁজে বের করে দিয়ে দেবেন না হয়!
এই বলে আমি হেঁটে শান্ত চত্বরের দিকে ভিজতে ভিজতে চলে গেলাম। পেছনে তাকাইনি। যদিও তাকাতে ইচ্ছে করছিল!

শান্ত চত্বরে বসে ঠান্ডায় কাঁপছি। বৃষ্টির বেগ তখনো কমেনি। ভেবেছিলাম শান্ত চত্বরে বসে একটা নতুন গল্পের প্লট নিয়ে ভাববো। কিন্তু হাড় যেভাবে কাঁপছে, তাতে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঠান্ডায় জ্বরে বেহুঁশ হয়ে যাবো। তবে আপাতত উঠে পড়ার চিন্তা করছি না। আমার চিন্তার সুঁতো ছিঁড়ে গেল কানে নারীকণ্ঠের আওয়াজ শুনে।
- আপনি তাহলে সত্যি এখানে আছেন!
আমাকে অবাক করে মেয়েটি এখন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাও কাকভেজা হয়ে গেছে, হাতে আমার বন্ধ করা ছাতাটা।
- ও, আপনি যাননি?
- আপনি কি ভেবেছিলেন ক্যাম্পাসে আপনিই একমাত্র প্রাণি, যার পাগলামি করার রোগ আছে?
- হা হা, প্রকৃতি তাহলে মাঝে মাঝে কল্পনার বিষয়বস্তুগুলোকে বাস্তবে এনে হাজির করে!
- স্বপ্নের মত কিছু বা সিনেমাটিক কিছু করার সাহস আসলে আমাদের সবার থাকে না।
- মন্দ বলেননি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে সেই মাততে পারে; যে তার খেয়াল-খুশিমত চলতে পারে।
- এজন্যই বুঝি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতেও রোম্যান্টিক হওয়ার চেষ্টা করছেন?
- এই মুহূর্ত যদি শেষ না হয়, তবে জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত রোম্যান্টিক হওয়ার চেষ্টা করবো।

আচমকা মেয়েটি আমার কাঁধে মাথা রাখলো। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। এখনকার অনুভূতিটাকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সুখের মত ব্যথা বলা যেতে পারে। আমার হার্ট বিট বাড়ছে। রক্ত চলাচলের গতিও দ্রুত হয়ে গেছে। কিছু বলার চেষ্টা করছি, তবে মুখ দিয়ে একটা রা-ও ফুটছে না।
মেয়েটিই নীরবতা ভেঙে দিলো। বেশি আনন্দে মারা যেতে ইচ্ছে করে কারো কারো। আমি হলাম সেই দলভুক্ত।
- আমি যদি ঠান্ডায় মারা যাই, তবে আমার প্রাণহীন দেহটা মনে হয় আপনার কোলেই লুটিয়ে পড়বে, তাই না?
- আমরা তার চেয়েও ভালোভাবে মরতে পারি।

মেয়েটি আমার কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে আমার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমার কেমন যেন ঘোর লাগা অনুভুতি হতে থাকলো। মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। মেয়েটি এখন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। আমার চারপাশ ক্রমেই ঝাপসা হতে লাগলো। মনে হচ্ছে, অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সেই হাসির আওয়াজ। মেয়েটির অস্পষ্ট কথা কানে বাজছে- ‘আপনি আর আমি! চলুন! উঠে দাঁড়ান! আমরা এখন মনের উল্লাসে হাসবো গাইবো।’

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ালাম। তারপর মেয়েটির হাতে হাত রেখে ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের মাঝে। এখন আর কাঁপুনি আসছে না অবশ্য। আমরা হেঁটেই চলেছি সামনের দিকে। আমি জানি না! মেয়েটি জানে! মেয়েটি আমার হাত আলতো করে ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

হুট করে পেছন থেকে আসা একটি চিৎকারে আমি ভীষণ চমকে গেলাম। মনে হলো আমার ঘোরটা কেটে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি রজতরেখা বাসের মামা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
- মামা! কী করছেন আপনি! গাজা বেশি খাইসেন না কি? আরেকটু হইলেই তো জান যাই তো আপনার!
- ও...ও...ওই মেয়েটা...
- মামা, কই মাইয়া? কোন মাইয়া?
আমি পাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। আমি একাই দাঁড়িয়ে কাঁপছি।

আমার সহ্যশক্তি একটু বেশি বলেই হয়তো তখনো জ্ঞান হারাইনি। কাঁপতে কাঁপতে ঠিকই শান্ত চত্বর ছেড়ে গেটের দিকে এলোমেলো পায়ে এগোচ্ছিলাম। ঠিক তখনই সেই পরিচিত নারীকণ্ঠ শুনে আরেকবার চমকে উঠলাম। সব ঠিক আছে মি. কবি?
- কে আপনি! সত্যি করে বলুন।
- সত্যি! সেটা আবার কোথা থেকে আসবে। আমাকে স্রেফ আপনার গল্পের প্লটের একটি অংশ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না।

আমি জবাবে কিছু বলতে যাব, এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকলো। তাকিয়ে দেখি তৃতীয় বর্ষের ছোট ভাই শিকদার সাকিব।
- ভাই আপনের এই অবস্থা কেন? আপনে তো রীতিমত কাঁপছেন! ব্যাগ থেকে তো দেখছি ছাতাটা বের হয়ে আছে, মাথায় দেন নাই কেন?
- ছাতা! আছে না কি!
ছাতাটি দেখে ভেতর থেকে আরেকবার ধাক্কা খেলাম।
- ভাই বাসায় চলেন, আপনার অবস্থা খুবই খারাপ।
- আচ্ছা চল।
পেছনে তাকিয়ে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করলাম না। কারণ জানি মেয়েটি আরেকবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।


উপদেষ্টা সম্পাদক: ডি. মজুমদার
সম্পাদক: মীর আক্তারুজ্জামান

সর্বস্বত্ব: এমআরএল মিডিয়া লিমিটেড
ঢাকা অফিস: মডার্ণ ম্যানসন (১৫ তলা), ৫৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০
ময়মনসিংহ অফিস: হাসনাইন প্লাজা (দ্বিতীয় তলা), ৭ মদন বাবু রোড, ময়মনসিংহ-২২০০
সেলফোন: ০৯৬১১-৬৪৫২১৫, ০৯৬৯৭-৪৯৭০৯০ ই-মেইল: jagrota2041@gmail.com
ফোন :
ইমেইল :