, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

‘বাঁশ দিয়ে পাকিস্তান কাঁপানো’ শহীদ মিরাজের গল্প

  নিজস্ব প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

‘বাঁশ দিয়ে পাকিস্তান কাঁপানো’ শহীদ মিরাজের গল্প

বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামানের কণ্ঠে আজও রাজ্যের আক্ষেপ, ‘ইশ! আমাদের মিরাজ যদি ফাইবার পোল দিয়ে লাফানোর সুযোগ পেত, তাহলে নির্ঘাত আরও অনেক উচ্চতায় লাফিয়ে, পাকিস্তানিদের দর্প চূর্ণ করে বয়ে আনতে পারত সোনালী সাফল্য। দেশ ও মহাদেশীয় পর্যায়ে আরও বড় সাফল্য বয়ে আনার ক্ষমতা ছিল তার। একজন জাত ও বড় পোলভল্টারের সব গুণই ছিল তার মধ্যে। কিন্তু দূর্ভাগ্য এ অসাধারণ মেধাবী অ্যাথলেটের, জীবনে কখনো ফাইবার পোল পায়নি। ফাইবারের বদলে বাঁশ দিয়ে লাফিয়েছে সব সময়। তারপরও পাকিস্তানি পোলভল্টারদের নাভিশ্বাষ তুলে ছেড়েছে। পাকিস্তানিরা মিরাজকে যমের মত ভয় পেত।’

'আফসোস, আমরা মিরাজকে ফাইবার পোল দিতে পারিনি। কী করে দেবো? আমদের দেশে যে তখনও ফাইবার আসেনি। অথচ দুঃখ লাগে পাকিস্তানিরা ঠিকই ফাইবার পোল দিয়ে লাফাত'- এই আক্ষেপমাখা কথাগুলো দেশবরেণ্য সাংবাদিক, দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অগ্রদূত, পথিকৃৎ কামরুজ্জামানের (একসময়ের নামি বাংলা পত্রিকা 'দৈনিক বাংলা'র ক্রীড়া সম্পাদক)।

ভাবছেন কে এই মিরাজ? কেনই বা তার জন্য দেশের প্রবাদপ্রতিম ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামানের এত আফসোস, অনুশোচনা? বর্তমান প্রজন্মের কাছে নামটি অচেনা, অজানা। তবে স্বাধীনতার আগে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খেলাধুলার খোঁজখবর যারা রাখেন, তাদের কাছে ‘মিরাজউদ্দিন’ মোটেই অচেনা কেউ নন, অতি পরিচিত এক নাম।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগপর্যন্ত দুই পাকিস্তানের অন্যতম নামি, মেধাবী ও সফল অ্যাথলেট ছিলেন এই মিরাজউদ্দীন। শুধু নামি অ্যাথলেটই ছিলেন না, মিরাজউদ্দিন যে মহান মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের এক অকুতোভয় সৈনিকেরও নাম। একাত্তরের সেই রক্তস্নাত দিনগুলোয় রাজধানী ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা মিরাজউদ্দিন এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাও।

দুঃখজনক হলেও সত্য, দুই পাকিস্তানের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে যিনি ছিলেন এক মেধাবী, প্রতিভাবান ও অমিত সম্ভাবনাময় পোলভল্টার, সেই মিরাজউদ্দিন দেশ মাতৃকার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেও যথাযথ মূল্যায়িত হননি।

মিডিয়ার কল্যাণে এখন মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা যোদ্ধাদের দল ‘ক্র্যাকপ্লাটুন’ এর অন্যতম সদস্য শহীদ ক্রিকেট জুয়েলের নাম সবার মুখে মুখে। তবে তার পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গনের অনেক পরিচিত নামের অবদান ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক ফুটবলার শহীদ লালু, শহীদ তপন, সাবেক ক্রিকেট সংগঠক শহীদ মুশতাক, লেখার আলোচ্য পোলভোল্টার মিরাজউদ্দিনসহ আরও অনেকে।

কিন্তু ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সালে দুই পাকিস্তানের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট বিশেষ করে তুখোড় ‘পোলভল্টার’ শহীদ মিরাজকে কজন চেনেন? একজন দেশবরেণ্য ক্রীড়াবিদ যিনি দেশ মাতৃকার জন্য অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক আর পোলভল্টের বাঁশ ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে হাসি মুখে নিজের জীবন করেছেন দান, তার নাম ক্রীড়াঙ্গনেরই বা কজন জানেন?

অথচ সত্তর ও আশির দশকের সব অ্যাথলেট, প্রশিক্ষক, সংগঠক, পৃষ্ঠপোষক বা ক্রীড়া সাংবাদিকের চোখে শহীদ মিরাজউদ্দিনই বাংলার সর্বকালের সেরা পোলভল্টার। দেশবরেণ্য ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান একা নন, মেধাবী ও প্রসিদ্ধ লিখিয়ে জালাল আহমেদ চৌধুরী, কাশিনাথ বসাকও শহীদ মিরাজের মেধাপ্রজ্ঞার কথা জানিয়েছেন।

দেশসেরা ক্রিকেট লিখিয়ে ও কথা সাহিত্যিক জালাল আহমেদ চৌধুরী শহীদ মিরাজ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, 'এখনও মিরাজের কথা মনে হয়। সে ইন্টার স্কুল অ্যাথলেটিকসেই সারা দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। একজন তুখোড় অ্যাথলেটের প্রতিচ্ছবি মিরাজের ঐ সময়ের অ্যাপ্রোচও ছিল ভিন্ন; খুব বিনয়ী, নম্র-ভদ্র।'

দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র রকিবুল হাসানও শহীদ মিরাজকে অনেক বড় অ্যাথলেট এবং উঁচুমানের পোলভল্টার বলে আখ্যা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে স্বাধীনতার আগে ১৯৬৯-১৯৭১ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিরাজকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে তিনিও শহীদ মিরাজের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, ‘মিরাজ ভাই দুর্দান্ত ক্রীড়াবিদ ছিলেন। দারুণ পোলভল্টার ছিলেন। তার মানের পোলভল্টার চোখে পড়েনি আর।'

কিন্তু হায়! তার সমসাময়িক ক্রীড়াবিদ, লেখক, সাংবাদিকরা যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, যার প্রতিভায় মুগ্ধ; সেই সাড়া জাগানো বীর শহীদ মিরাজউদ্দিনের নাম যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। শহীদ মিরাজের সাফল্য, রেকর্ড সেভাবে সংরক্ষিত নেই। মিরাজ ঠিক কেমন মানের অ্যাথলেট ছিলেন?- তা জানার জন্য গুগল বা উইকিপিডিয়ায় সার্চ দেয়ার দরকার নেই। স্বাধানীতার আগে ১৯৭০ সালে দুই পাকিস্তান অলিম্পিক (পাকিস্তান গেমস) গেমসের মার্চ পাস্টে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পতাকা বহন করেছিলেন পোলভল্টার ও হার্ডলার মিরাজউদ্দীন।

এমন বড় ও নামি অ্যাথলেটের নামে কোনও স্মৃতিফলকও নেই। সারা বাংলাদেশ ঘুরে তার একটি স্মৃতিচিহ্নও খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তবে মানিকগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শহীদ মিরাজের নাম। মানিকগঞ্জের আরেক বরেণ্য ক্রীড়াবিদ, যিনি স্বাধীনতার আগে ঢাকা লিগে ছিলেন পরিচিত মুখ, সেই সাবেক ফুটবলার শহীদ তপনের সঙ্গে মিলিয়ে ‘শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়াম’ নামকরণ করা আছে মানিকগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামের।

তুখোড় অ্যাথলেট মিরাজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ভাটিকান্দা গ্রামে। তার আদি নিবাস মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইউনিয়নের পাঞ্জনখাড়ায়। মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবা শরীফউদ্দিন আহমেদকে হারিয়ে হন পিতৃহারা। বিধবা মা হাজেরা খাতুন তাকে বড় করেছেন মানুষের মতো মানুষ করে।

মিরাজের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হরিরামপুরের লেছরাগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন হরিরামপুরে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু হাইস্কুলে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউটে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম সুতিকাগার এই নবকুমার ইন্সটিটিউটে পড়া অবস্থায় আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১১০ মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট ও লং জাম্পে অসাধারণ নৈপূন্য দেখিয়ে সাড়া ফেলেন মিরাজ।

এরপর জগন্নাথ কলেজ হয়ে নাম লেখান দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছয় ফুটের বেশি উচ্চতার সুদর্শন মিরাজের প্রিয় ইভেন্ট ছিল পোলভল্ট, হার্ডলস এবং লং জাম্প। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানের আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে ঐ তিন ইভেন্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিলেন মিরাজ। পরের বছর (১৯৬৪ সালে) পাকিস্তানের লাহোরে প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি।

মিরাজ যে কত বড় মানের আর প্রতিভাবান অ্যাথলেট ছিলেন, তার জ্বলন্ত নজির মেলে ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান আন্তঃকলেজ বার্ষিক ক্রীড়ায়। যখন তিনি ঢাকার জগন্নাথ কলেজের হয়ে ১১০ মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট এবং লং জাম্পে নতুন জাতীয় রেকর্ড স্থাপন করে বসেন।

১৯৬৬ সালে লাহোরে ১০ম পাকিস্তান অলিম্পিকেই মিরাজ নিজের সত্যিতার মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় রাখেন। পোলভল্টে পাকিস্তান অলিম্পিক রেকর্ড করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি অ্যাথলেটদের মধ্যে মিরাজই একমাত্র স্বর্ণপদক বিজয়ের অনন্য কৃতিত্ব স্থাপন করেন। শুনতে অবাক লাগবে, কিন্তু কঠিন সত্য এই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের পোল ভল্টাররা ফাইবাল পোল দিয়ে লাফিয়ে যা পারেননি, বাঙালি মিরাজ বাঁশ দিয়ে লাফিয়ে ১২ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতা অতিক্রম করেছিলেন।

jagonews24

শ্রুতি আছে, সে সময়ের পাকিস্তানের জার্মান অ্যাথলেটিকস কোচ হফম্যান বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটি একটি ফাইবার পোল পেলে এশিয়ান গেমসের রেকর্ডও গড়ে ফেলতে পারবে।’ বাঁশের পোল দিয়ে মিরাজের গড়া সেই রেকর্ড বহুবছর কেউ ছুঁতে পারেনি। সত্তর দশকের শেষে এসে বাংলাদেশের পোলভল্টাররা তা অতিক্রম করেন।

এরপর ১৯৭০ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এ তিনটি ইভেন্টে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিলেন মিরাজউদ্দিন। একই বছর করাচি হকি ক্লাব মাঠে পাকিস্তানের দ্বাদশ জাতীয় গেমসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াদলের পতাকা হাতে মার্চপাস্টের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মিরাজ। নিজ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সেরা অ্যাথলেট হিসেবে মিরাজকে ঠিকই স্বীকৃতি দিয়েছিল।

ক্রীড়াঙ্গনের সফল অ্যাথলেট মিরাজ ছিলেন বরাবরই মিশুক ও প্রাণখোলা মানুষ। বন্ধুবৎসল মিরাজ নিজ গুণে রাজনীতির মাঠেও ছিলেন সফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন মিরাজউদ্দিন ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন।

বাঙালি ক্রীড়ীবিদরা যখন অবহেলিত, তখনও মেধাবী পোলভল্টার মিরাজকে অবমূল্যায়ন করতে পারেনি পাকিস্তানিরা। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মিরাজ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসহ শহরের অলিগলি পাক হানাদারদের পৈশাচিক, নৃশংস ও বর্বরোচিত গণহত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড কাঁপানো মিরাজের মন। এক মুহূর্ত দেরি না করে ঢাকা ছেড়ে চলে যান মানিকগঞ্জের হরিরামপুর গ্রামে মায়ের কাছে। গাঁয়ে বসে দেশ মাতৃকার স্বাধীকার ও মুক্তি সংগ্রামের লক্ষে নিজেকে প্রস্তুত করেন। গাঁয়ের তরুণ, যুবাদেরও অনুপ্রাণিত করতে থাকেন।

এপ্রিলে খবর পান মানিকগঞ্জ ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হরিরামপুরে ঘাঁটি গেড়েছেন মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল হালিম চৌধুরী। বিধবা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন হালিমের কাছে হাজির হন মিরাজ। পোলভল্টের বাঁশের পোল ছেড়ে হাতে নেন অস্ত্র। শুরু থেকেই গেরিলা যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এ অসীম সাহসী বীর।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানিকগঞ্জের সেক্টর কমান্ডার প্রকৌশলী তবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ঘটে ঐতিহাসিক গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। টাইগার লোকমান, নবাবগঞ্জের মনসুর আর মিরাজদের মরণপণ হামলায় নিহত হয় ৮১ পাকিস্তানি সেনা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার মাসদেড়েক আগে (২ নভেম্বর ১৯৭১) পাকিস্তানিদের অবাধে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ যাতায়াত বন্ধে মিরাজদের ওপর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বানিয়াজুরি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব বর্তায়। রাতের আঁধারে শুরু হয় অপারেশন।

কিন্তু বিধিবাম। ব্রিজে ডিনামাইট বসাতে গিয়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের হাতে ধরা পড়ে যান মিরাজ। তাকে চিনতে দেরি হয়নি হানাদারদের দোসরদের। বন্দী মিরাজকে মানিকগঞ্জের ক্যাম্পে না নিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার আর্মি হেড কোয়ার্টারে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে নির্মম নির্যাতন। হাজারও নির্যাতনের মুখে মিরাজের কাছ থেকে সহযোদ্ধাদের খবর বের করতে পারেনি তারা।

এরই একপর্যায়ে আহত মিরাজকে দেখানো হয় পাকিস্তান টেলিভিশনে। পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দুষ্কৃতিকারী হিসেবে। তারপর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৭ ডিসেম্বর সকালে বিজয়ের আনন্দে মিরাজের ভাইসহ পরিবারের সবাই ছুটে যান সেখানে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাদের জানান এক কঠিন সত্য, মিরাজউদ্দিন তো জেলে নেই। ৮ ডিসেম্বর সকালে আলবদর বাহিনীর পরিচালক মেজর মোস্তাক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মিরাজকে পাকবাহিনীর জিপে করে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর আজও কোনও খোঁজ মেলেনি মিরাজউদ্দিনের।

ধারণা করা হয়, হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র মিরাজকে ঠিকই চিনত। আর তাই পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাঙালি জাতিকে বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকশূন্য করার ঘৃণ্য প্রয়াসে অকাতরে মেরে ফেলেছে পাকিস্তানিরা।

সেই সাথে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের সফল অ্যাথলেট ও যুদ্ধের ময়দানের সাহসী যোদ্ধা মিরাজও প্রাণ হারিয়েছেন পাক হানাদার ও তাদের দোসর আল বদর, আল শামসদের হাতে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি হারিয়েছে এক অসামান্য প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদকে।

অনেক বিদগ্ধ ক্রীড়া বিশ্লেষকের মত, শহীদ মিরাজউদ্দিনের মত অত উঁচুমানের ও অসামান্য পোলভল্টার আর আসেনি। তিনি সত্তরের দশকে বাঁশ দিয়ে যে উচ্চতায় লাফিয়ে উঠতেন, তা ফাইবারের পোল দিয়ে অতিক্রম করতেও লেগে গেছে ৬-৭ বছর।

বিজয়ের ৫০ বছর হয়ে যাচ্ছে। একজন দক্ষ পোলভল্টারের প্রতিমূর্তি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সাহসী গেরিলা যোদ্ধা শহীদ মিরাজউদ্দিনের সাফল্য, কীর্তি ও অবদানের কথা হারিয়ে যায়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে তা প্রচার-প্রসারের যে এখনই সময়।

পেপার কাটিং ও ব্যক্তিগত তথ্য কৃতজ্ঞতাঃ রিয়াজউদ্দিন আহমেদ তিতাস (শহীদ মিরাজউদ্দিনের ভাইয়ের ছেলে)

  • সর্বশেষ - খেলাধুলা