2024-04-26 09:15:40 am

চট্টগ্রাম ও খুলনার আলোচিত দুই হত্যাকাণ্ড নির্দেশদাতারাই চার্জশিটে নেই

www.focusbd24.com

চট্টগ্রাম ও খুলনার আলোচিত দুই হত্যাকাণ্ড নির্দেশদাতারাই চার্জশিটে নেই

০৩ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৯ মিঃ

চট্টগ্রাম ও খুলনার আলোচিত দুই হত্যাকাণ্ড নির্দেশদাতারাই চার্জশিটে নেই

নিহত নুরুল আবছার ও নির্দেশদাতা আবদুল মোনাফ। ছবি: সংগৃহীত

‘ওসমান মামু আমাদের বলে, নুরুল আবছার প্রফেসরকে খুন করতে কত টাকা লাগবে? তখন মোনাফ চেয়ারম্যানও আমাদের সামনে বসা ছিল। আমি শাহ আলমকে বলি, তুমি দরদাম ঠিক করো। শাহ আলম ৮ লাখ টাকা চায়। মোনাফ চেয়ারম্যান ও ওসমান মামু পরামর্শ করে ৬ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়। এর মধ্যে ২ লাখ টাকা অ্যাডভান্স দিতে রাজি হয়। মোনাফ চেয়ারম্যান তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুই বান্ডেল টাকা বের করে ওসমানের হাতে দেয়। ওসমান মামু টাকাগুলো আমাকে দেয়। আমি টাকাগুলো শাহ আলমকে দেই। মূলত রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ওসমান ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোনাফ আমাদের দিয়ে নুরুল আবছার চেয়ারম্যানকে হত্যা করিয়েছে।’ চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় আলোচিত প্রফেসর নুরুল আবছার হত্যা মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় এমন জবানবন্দি দেন আসামি মো. জসিমউদ্দিন। শুধু এই আসামি নন, আরো চার জন আসামি তাদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খুনের পরিকল্পনাকারী হিসেবে ওসমান ও মোনাফের নাম বলেছেন। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এই খুনের পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা ওসমান ও মোনাফকে বাদ দিয়ে বাকি ১৩ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্যা।


শুধু নুরুল আবছার হত্যাকাণ্ডই নয়, খুলনায় উজ্জ্বল কুমার হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা সি ফুড ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান ওরফে স্টারলিংয়ের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থাকার পরেও তাকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন পুলিশ ও সিআইডির দুজন তদন্ত কর্মকর্তা। মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে পুনঃতদন্তের আবেদন জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। ঐ আবেদন মঞ্জুর করে খুলনার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত। তদন্ত কর্মকর্তাদের এমন ভূমিকায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিচারকেরা বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তারা ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের পরিবর্তে আদালত ও প্রসিকিউটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সত্য ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, যা কোনোভাবেই আইন সমর্থিত নয়।


এদিকে হত্যা মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন তিন আসামি। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রবিবার মামলা বাতিলের আবেদন নাকচ করে দেয়। আদালত বলেছে, অধস্তন আদালতের বিচারকেরা যে আদেশ দিয়েছেন, তাতে বেআইনি কিছু পরিলক্ষিত হয়নি।


চট্টগ্রামে অব্যাহতিপ্রাপ্ত চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে গ্রহণ


চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাতে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয় নুরুল আবছারকে। তিনি ঘটনার সময় নলুয়া ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং সাতকানিয়া জাফর আহম্মদ চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এ ঘটনায় নিহতের পিতা আহমেদ হোসেন মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে এবং রাজনৈতিক কারণে সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মোনাফ, গত নির্বাচনের ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থী ওসমান গণি চৌধুরী, মো. সারওয়ার সালাম ও আবু তাহেরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাতকানিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্যা ২০১৮ সালে ১৩ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। তবে এজাহারভুক্ত আসামি মোনাফ, ওসমান গণিসহ ছয় জনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে আদালতে আবেদন করেন। এই তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেন বাদী। ঐ নারাজি আবেদন আংশিক গ্রহণ করে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়ন্তী রাণী রায় আদেশে বলেছেন, মামলার আসামি জসিমউদ্দিনসহ পাঁচ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং রাষ্ট্রপক্ষে ৩৪ জন সাক্ষীর ১৬১ ধারায় জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামি মোনাফ ও ওসমান গণি চৌধুরী জড়িত। এছাড়া ১৮ জন সাক্ষী আসামি মোনাফ, ওসমান গণি, আবু তাহের, সারোয়ার সালাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত মর্মে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামি ও সাক্ষীদের জবানবন্দিতে খুনের সঙ্গে এদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরেও কোন আইনবলে এবং কীভাবে চার্জশিট থেকে এদের অব্যাহতি দিতে তদন্ত কর্মকর্তা আবেদন করেছেন, তা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।


আসামি জসিমের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য না মিথ্যা, ষড়যন্ত্র হয়েছিল কি হয়নি বা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা বিচারিক আদালতের বিষয়। তদন্ত কর্মকর্তার এ ধরনের কর্মকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য ও আইনবহির্ভূত। এতে ওনার তদন্তকাজে স্পষ্ট অদক্ষতা ও অবহেলার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। সার্বিক পর্যালোচনায় মোনাফ, ওসমান, আবু তাহের ও সারোয়ার সালামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪/১০৯ ধারার অপরাধ আমলে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান থাকায় তাদের চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হলো। এই আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করে আসামিরা। কিন্তু ঐ রিভিশন খারিজ করে দেয় আদালত। ঐ আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে মামলা বাতিলের আবেদন করেন মোনাফ ও ওসমান গণি। আবেদনের পক্ষে কুমার দেবুল দে ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী শুনানি করেন। হাইকোর্ট মামলা বাতিলের আবেদন উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেয়। ডিএজি বলেন, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে কারো নাম আসার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।


খুলনার উজ্জ্বল কুমার হত্যা মামলা অধিকতর তদন্তের নির্দেশ হাইকোর্টের


২০১২ সালের ৭ জুন সকালে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় উজ্জ্বল কুমার সাহাকে। এ ঘটনায় তার ভাই সুমন কুমার সাহা খুলনা থানায় মামলা করেন। এই মামলার প্রধান আসামি মেহেদী হাসান ওরফে স্টারলিংসহ পাঁচ আসামি রিমান্ড ছাড়াই ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। ঐ জবানবন্দিতে আসামিরা উল্লেখ করেন যে, মেহেদী হাসান স্টারলিং এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও পরিকল্পনাকারী। মেহেদী ও অপরাপর আসামিদের জবানবন্দি থাকার পরেও মামলাটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. সোহেল রানা এবং অধিকতর তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক শেখ শাহজাহান চার্জশিট থেকে মেহেদীকে বাদ দিয়ে অব্যাহতির আবেদন করেন। চার্জশিট দেন আট আসামির বিরুদ্ধে। ঐ আবেদন মঞ্জুর করে মামলার বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ২০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণের এই পর্যায়ে এসে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর কাজী সাব্বির আহম্মেদ পুনঃতদন্তের আবেদন জানান। ঐ আবেদন মঞ্জুর করে খুলনার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এস এম আশিকুর রহমান আদেশে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা অব্যাহতির আবেদনে দাবি করেছেন যে, স্টারলিং গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঘটনার আকস্মিকতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মনগড়া বিচারিক জবানবন্দি দিয়েছেন।


তদন্তকালে ঐ জবানবন্দির সত্যতা পাওয়া যায়নি। কিন্তু স্টারলিং তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘আমি ব্রাইট সি ফুড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মডার্ন সি ফুড কোম্পানির পরিচালক। উজ্জ্বল আমার কোম্পানির কর্মচারী। অর্থ আত্মসাতের দায়ে সে পদত্যাগ করে। সে আমার কোম্পানিতে থাকাকালে এবং কোম্পানি থেকে চলে আসার পর আমার পিতামাতা ও স্ত্রীর কান ভারী করত। সে তার স্ত্রীকে দিয়ে আমার স্ত্রীর কাছে আমাকে নিয়ে নানা কথা বলত, যার কারণে আমার স্ত্রী চলে যায়। চার মাস কোনো যোগাযোগ ছিল না। এসব বিষয় নিয়ে উজ্জ্বলের সঙ্গে তার তিক্ত সম্পর্ক হয়। আমি তাকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলাম।’


এ বিষয়ে বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আত্মস্বীকৃত মূল পরিকল্পনাকারীকে বাদ দিয়ে অন্য আসামিদের বিচার করার ঘটনায় ধারাবাহিক কাজে ছেদ পড়বে। তদন্ত কর্মকর্তারা আদালতের একচ্ছত্র এক্তিয়ারের ওপর তথা মামলার বিচার কার্যক্রমে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছেন। এতে শুধু রাষ্ট্র ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে না, ভিকটিমের আত্মা আমাদের বিচারিক মানসের প্রতি নিরন্তর অভিসম্পাত করতে থাকবে। এ কারণে মামলাটি বিচারকাজ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে পুনঃতদন্তের আদেশ দেওয়া হলো। এই আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং মামলা বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন আসামি আরিফুল হক ওরফে সজল। বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ পুনঃতদন্তের আদেশ সংশোধন করে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। আসামিপক্ষে মামলা করেন হাসানুজ্জামান উজ্জ্বল।


উপদেষ্টা সম্পাদক: ডি. মজুমদার
সম্পাদক: মীর আক্তারুজ্জামান

সর্বস্বত্ব: এমআরএল মিডিয়া লিমিটেড
ঢাকা অফিস: মডার্ণ ম্যানসন (১৫ তলা), ৫৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০
ময়মনসিংহ অফিস: হাসনাইন প্লাজা (দ্বিতীয় তলা), ৭ মদন বাবু রোড, ময়মনসিংহ-২২০০
সেলফোন: ০৯৬১১-৬৪৫২১৫, ০৯৬৯৭-৪৯৭০৯০ ই-মেইল: jagrota2041@gmail.com
ফোন :
ইমেইল :