2024-04-20 08:34:16 pm

রুদ্র তার বিখ্যাত গানটি প্রথম আমাকে শুনিয়েছিল: ইসহাক খান

www.focusbd24.com

রুদ্র তার বিখ্যাত গানটি প্রথম আমাকে শুনিয়েছিল: ইসহাক খান

০৮ মার্চ ২০২১, ১৩:৫৬ মিঃ

রুদ্র তার বিখ্যাত গানটি প্রথম আমাকে শুনিয়েছিল: ইসহাক খান

ইসহাক খান কথাসাহিত্যিক, গল্পকার ও নাট্যকার। তার জন্ম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার কানসোনা গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেন। পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। গল্প, উপন্যাস ও শিশুতোষ বইসহ মোট ত্রিশটি বই প্রকাশ হয়েছে। টিভি নাট্যকার হিসেবেও বিশেষভাবে পরিচিত। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রায় শতাধিক নাটক প্রচারিত হয়েছে।

তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ময়মনসিংহ, কামালপুর, হাতিবান্ধা ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৮২ সালে তথ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে পুরস্কৃত হন। এ ছাড়া সাহিত্যে অবদানের জন্য ‘ডাকসু সাহিত্য পুরস্কার’, ‘সোনার বাংলা সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা’, ‘শুভজন লেখক সম্মাননা’ ও ‘আমরা ক’জনা সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।

বর্তমানে তিনি মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ইসহাক খানের সাথে কথা হয় । সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী সাজেদুর আবেদীন শান্ত—

>> প্রথম লেখা কোথায় প্রকাশ হয়? সে সময়ের অনুভূতি কেমন ছিল?
ইসহাক খান: প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭২ সালে কলেজ ম্যাগাজিনে। এর আগে আমার লেখা একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। সেটি টিকিট কেটে দেখেছে মানুষ। তবে ছাপার অক্ষরে কলেজ ম্যাগাজিনেই প্রথম। যখন নিজের লেখা ছাপা হয়; অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম। নিজের লেখাই তখন বারবার দেখতে লাগলাম যে, ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখতে কেমন লাগে। এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি। এ অনুভূতি প্রকাশ করা বা বোঝানো কঠিন। তখন আমার মনে হতো, আমার বই লাইব্রেরিতে থাকুক। বইয়ে আমার নাম থাকুক। তখন থেকেই লেখক হওয়ার একধরনের বাসনা তৈরি হয়।

>> আপনার প্রথম বই কবে বের হয়?
ইসহাক খান: আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে। বইটি ছিল গল্পগ্রন্থ। নাম ছিল ‘নগ্ন নাট মন্দির’।

jagonews24

>> প্রথম বই বের হওয়ার পর কেমন লেগেছে?

ইসহাক খান: প্রথম বই বের হওয়ার পর নিজেই আগ্রহ নিয়ে সিনিয়রদের বাসায় গিয়ে দিয়ে এসেছি। বলেছি, আপনারা দেখবেন, পড়বেন। এমনকি আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় গিয়েও দিয়ে এসেছি। তারা খুশি যে, আমার বই বের হয়েছে, আমি একজন লেখক। তবে এতে বাবা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন। বাবা আমাকে খুবই অপছন্দ করতেন। আমি বাবাকে নিয়ে একটা বই লিখেছি, ‘আমার বাবা’। আমি ঢাকায় থাকতাম, একবার ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি। একদিন দুপুরে খাওয়ার পরে কাচারি ঘরে শুয়ে আছি। আমাদের কাচারি ঘরের আবার দু’পাশ খোলা। আর দু’পাশে বেড়া দেওয়া। সেখানে একটি চৌকি আছে। আমি সেখানে শুয়ে আছি। ঘরের সামনে বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানে বাবা আর দু’জন গল্প করছেন। লোক দু’টো আমাকে দেখে বাবাকে বলছেন, ‘উনি কে? ওনাকে তো চিনলাম না চাচা?’ তখন আমার বাবা বলছেন, ‘ও আমার ছেলে, ঢাকায় থাকে। তাই হয়তো দেখনি।’ তারা বলেন, ‘কী করে?’ তখন বাবা বললেন, ‘লেখক।’ আমার সম্পর্কে তার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা আমাকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে। আমার বাবা পরিচয় দিচ্ছেন আমার ছেলে লেখক। ততদিন পর্যন্ত জানতাম, বাবা আমাকে পছন্দ করেন না। ওইদিন থেকেই আমার ধারণা একদম পাল্টে গেল। আমি ভেতরে ভেতরে এত খুশি হলাম যে, খুশিতে আমার কান্না পেয়ে গেছে। প্রথম বই প্রকাশের পর আমার অনুভূতি এমন। এ ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করা খুব কঠিন। বোঝানো যায় না, নিজে নিজে অনুভব করা যায়।

>> লেখালেখির ক্ষেত্রে কে আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন?
ইসহাক খান: লেখালেখির ক্ষেত্রে কেউ যে আমাকে অনুপ্রাণিত বা উৎসাহিত করবে; এমন কেউ করেনি। তবে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি বাবার এ ধরনের কথায়। সেটা হলো, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি; তখন আমরা যারা লেখালেখি করি- এরকম তিন তরুণকে ঢাকা রেডিও ডেকেছিল একটা সাক্ষাৎকারের জন্য। আমি এটা বাড়িতে বলেছিলাম, আমার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছে; তা রেডিওতে প্রচার করবে। আমাদের বাড়িতে রেডিও নেই। আমার বাবা ওই সময় একজনের বাড়িতে গিয়ে রেডিওতে আমার সাক্ষাৎকারটি শুনেছেন। এটি আমার মায়ের মুখে শুনেছি। শোনার পরে আমার ভেতর লেখার যে প্রেরণাটা, তা আরও তীব্র আকার ধারন করে। বাবার নীরব ভালোবাসা লেখালেখিতে আমাকে সাংঘাতিক অনুপ্রাণিত করেছে। এ ছাড়াও আমার স্ত্রী শ্যামলীও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমার লেখা কোথাও প্রকাশ হলে সে আমার চেয়েও দ্বিগুণ খুশি হয়। তার সাথে আমার সম্পর্কই লেখালেখির মাধ্যমেই। আমি লেখালেখি করি, এজন্য সে সব কিছু ত্যাগ করে আমার কাছে চলে এসেছে।

>> সেই সময়কার কবি-লেখকদের মধ্য কাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন?
ইসহাক খান: সেই সময় আমরা যারা লেখালেখি করতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা একসাথেই থাকতাম। যেমন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল চৌধুরী, তুষার দাশ, রেজা সেলিম, ফারুক মঈনউদ্দীন, মঈনুল আহসান সাবের। তবে মঈনুল আহসান সাবের, ইমদাদুল হক মিলন, ইসমাইল হোসেন আমাদের প্রথম বই একই সঙ্গে বের হয়, ১৯৮২ সালে।

jagonews24

>> আশির দশকের কাদের কবিতা আপনাকে ভালো লাগতো? আপনার প্রিয় কবি কে?
ইসহাক খান: তখন আমার বন্ধুদের মধ্যে রুদ্রর কবিতা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো। ওর অনেক কবিতার জন্ম আমার চোখের সামনে। কারণ ও থাকতো আমার কাছে। আমি তো হলে (জসীম উদদীন হল) থাকতাম। আমি কোনোদিন একা থাকতে পারিনি। রুদ্র আর আমি থাকতাম। ও কিন্তু হলে থাকতো না। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো। কিন্তু বাসায় থাকতো না। মাঝে মাঝে যেত ঝাড়-ঝুড় দিয়ে আবার চলে আসতো। অথবা আমি আর সে যেতাম, গিয়ে দু-এক দিন থেকে আবার চলে আসতাম। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক সে আমার হলে থেকেছে। আমার হল হলো ওর ঠিকানা। মাঝে মাঝে ওর চিঠি-পত্র আসতো আমার হলের ঠিকানায়। আর ভালো লাগতো কামালের কবিতা। এই হলো আমার সমসাময়িকদের তালিকা, যাদের কবিতা আমার ভালো লাগতো। এ ছাড়াও শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, গুণদা এদের কবিতা আমার ভালো লাগতো। রাহমান ভাইয়ের কবিতা আমার খুব প্রিয় ছিল। তার অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ।

>> কবিবন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে আপনার একটি স্মৃতি যদি জানাতেন—
ইসহাক খান: রুদ্রকে নিয়ে তো আমার অনেক কাহিনি, অনেক স্মৃতি। আমরা একসাথে ছিলাম প্রায় দশ বছর। তবে ওর একটা বিখ্যাত গান আছে, ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’। গানটি নিয়ে একটা স্মৃতি বলি। সেটা হলো যে, তখন ও গ্রামে গেছে। তখন তো মোবাইল ছিল না। যোগাযোগের মাধ্যম তখন চিঠি। আমি অবশ্য চিঠি খুব কম লিখতাম। তবে রুদ্রর চিঠি লেখার অভ্যাস ছিল খুব। ও গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে না, আসে না। অনেক দিন হয়ে গেল। প্রায় ৬ মাস। একদিন দুপুরের পরে সে হলে এসে হাজির, রুদ্র। আমি তো ওকে দেখে একদম চমকে উঠেছি। দেখেই একটা গালি দিয়ে বলে উঠলাম, ‘তুই কই হারিয়ে গেছিস বেটা? তোর কোনো খবর নেই? তুই বেঁচে আছিস, না মরে গেছিস তা-ই তো জানি না?’ ও বলে, ‘ছিলাম, অনেক ব্যস্ত ছিলাম, অনেক কাজে ছিলাম, অনেক কাহিনি আছে, তোকে বলবো। চল এখন বের হই।’

সেখান থেকে আমরা একটা আড্ডায় বসতাম। সে আড্ডায় নেশা-টেশারও ব্যবস্থা ছিল। সেখানে চলে গেলাম। সেই আড্ডায় সে (রুদ্র) বলে যে, ‘আমি কিছু গান লিখছি এবং আমি মিঠেখালীতে একটা গানের দল করেছি। তিন জন মিলে সে গানের দলের নাম হলো ‘অন্তর বাজাও’। সেই দলে আমি এই গানগুলোর সুর করেছি। তোকে শোনাই, শোন।’ প্রথমেই সে এ গানটা ধরলো। আমি ওর গানের বাণী শুনেই একদম থ’ হয়ে গেছি। এত চমৎকার গান। একটু পর আমাকে বলে, ‘এই তুই বসে আসিস ক্যান? গানের সঙ্গে পো ধর।’ পো ধর মানে গানের সাথে সঙ্গী হওয়া। আমি ওর সাথে মেলাতে পারছি না। আমার সুরটা ঠিক হচ্ছে না। তারপর ও আমাকে গালি দিয়ে বলে, ‘হালার পো, তুই এটা পারছিস না?’ একপর্যায়ে আমি এটা পারলাম এবং অনেকবার গানটা গাইলাম। এরপর আরও দুটি গান গাইলাম। সেগুলোও খুব জনপ্রিয় গান ওর। তবে এ গানটাই আমাকে খুব টাচ করেছে। আমরা যখন ফিরছি; তখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে আমরা রিকশার হুড খুলে ভিজতে ভিজতে গান গাইতে গাইতে হলে চলে এলাম। মিঠেখালীতে গানটি লিখলেও ঢাকা এসে গানটি প্রথম যাকে শুনালো সে হলাম আমি। বিখ্যাত গানটি আমি প্রথম শুনলাম। তবে আমাদের আড্ডায় নিয়মিত গানটি গাওয়া হতো।

jagonews24

>> আপনি কী লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? গল্প, কবিতা, উপন্যাস না-কি প্রবন্ধ?
ইসহাক খান: আমি গল্প লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কবিতা খুব কম লিখেছি। গল্পই বেশি লিখেছি। আমার আসলে স্বাচ্ছন্দ্য কী? একেক সময় আমি একেকটা লিখতাম। যেমন ধরেন, শুরু হয়েছে আমার নাটক দিয়ে। কলেজ ম্যাগাজিনে আমার যে লেখাটি প্রকাশ হয়েছে, তা ছিল একটা নাটক। যখন আমি সিরাজগঞ্জ কলেজে পড়ি; তখন নাটক লেখার প্রতি আগ্রহ কমে গেল। আমি গল্প লেখা শুরু করলাম।

>> তরুণ লেখকদের প্রতি আপনার উপদেশ কী?
ইসহাক খান: উপদেশ ঠিক না, পরামর্শ বলতে পারেন। তরুণদের প্রতি প্রথম কথা হলো, অনেক পড়তে হবে। বেশি বেশি পড়তে হবে। বেশি বেশি ভাবতে হবে। বেশি বেশি নির্দয় হতে হবে, একটি লেখা লিখে লেখাটি অসাধারণ হয়ে গেল; এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। লেখা পছন্দ না হলে লেখা ছিঁড়ে ফেলতে হবে। আবার সেটি নতুন করে লিখতে হবে। এ ছাড়াও সমসাময়িক ও সিনিয়ররা কী লিখছেন; সেটা অনুধাবন করতে হবে। সেখান থেকে তার নিজের একটা আলাদা পথ তৈরি করতে হবে। যে ওর মতো লিখবো না। ও যেটা লিখেছে তার চেয়ে আলাদা লিখতে হবে। আর প্রচুর বই পড়তে হবে। তবে যা পেলাম; তা-ই পড়লাম এমন নয়, বেছে বেছে পড়তে হবে। এটাই তরুণদের প্রতি আমার পরামর্শ বা অনুরোধ।


উপদেষ্টা সম্পাদক: ডি. মজুমদার
সম্পাদক: মীর আক্তারুজ্জামান

সর্বস্বত্ব: এমআরএল মিডিয়া লিমিটেড
ঢাকা অফিস: মডার্ণ ম্যানসন (১৫ তলা), ৫৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০
ময়মনসিংহ অফিস: হাসনাইন প্লাজা (দ্বিতীয় তলা), ৭ মদন বাবু রোড, ময়মনসিংহ-২২০০
সেলফোন: ০৯৬১১-৬৪৫২১৫, ০৯৬৯৭-৪৯৭০৯০ ই-মেইল: jagrota2041@gmail.com
ফোন :
ইমেইল :