2024-03-29 02:11:07 am

শিথিল হচ্ছে বহুল আলোচিত সড়ক আইন

www.focusbd24.com

শিথিল হচ্ছে বহুল আলোচিত সড়ক আইন

০১ মে ২০২১, ১২:২২ মিঃ

শিথিল হচ্ছে বহুল আলোচিত সড়ক আইন

পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের দাবিই মেনে নিল সরকার। শিথিল হচ্ছে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন। আট বছর ঝুলে থাকার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে ২০১৮ সালে পাস হওয়া আইনটি সংশোধান করে জেল-জরিমানা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আইনের ৩৪টি ধারা শিথিল করতে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিল। সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় আইনের ১২৬টি ধারার ২৯টিতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। ভারী ও মাঝারি মোটরযানের সংজ্ঞাসহ আটটি বিষয়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধনী খসড়ায়। তবে সবচেয়ে স্পর্শকাতর পরিবর্তনের প্রস্তাব হলো, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে তিন লাখ টাকা করা। এ অপরাধের মামলা জামিন অযোগ্য ছিল। পরিবহন নেতাদের দাবির মুখে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করার মামলা এবং গাড়ির আকার-আকৃতি পরিবর্তনের মামলা জামিনযোগ্য করা হচ্ছে।

গত ১৩ এপ্রিল সংশোধিত আইনের খসড়া সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী ১৩ মে পর্যন্ত খসড়ার ওপর মতামত জানাতে পারবেন অংশীজন ও জনসাধারণ। এর পর খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। অনুমোদন পেলে সংসদে উত্থাপন করা হবে। সেখানে পাস হলে আইনের সংশোধন কার্যকর হবে।

আইন সংশোধনের এ উদ্যোগকে পরিবহন নেতাদের দাবি পূরণ বলেছেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেছেন, সবার সম্মিলিত চেষ্টার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একটি গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল আইনটির পক্ষেই। সে কারণেই আইনটি হয়েছিল। পরিবহন নেতাদের চাপে তা পরিবর্তন করা হলে সড়ক আরও অনিরাপদ হবে।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইউছুব আলী মোল্লা বলেছেন, আইন এখনই সংশোধন হচ্ছে না। সংশোধনের খসড়ার ওপর সব অংশীজন ও জনসাধারণের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে। যে মতামত আসবে, তা সমন্বয় করা হবে।

২০১৯ সালের ১ নভেম্বর সড়ক আইন কার্যকর করা হয়। তখন থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা আইনটিকে কঠোর ও তাদের স্বার্থবিরোধী আখ্যা দিয়ে আন্দোলনে নামেন। তারা ‘কঠোর’ আইনটি সংশোধন করে শিথিলের দাবিতে কর্মবিরতির নামে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। ব্যাপক জনদুর্ভোগের মুখে আইনের ৯টি ধারা প্রয়োগ স্থগিত রাখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বাধীন কমিটি।

মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ৩৪টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়ে সরকারকে কয়েক দফা চিঠি দেয়। তাদের সঙ্গে দুই বছর আলোচনার পর সরকার সংশোধনের যে খসড়া প্রকাশ করেছে, তাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবিরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

সবচেয়ে আলোচিত ১০৫ ধারায় জরিমানা কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হলে দণ্ডবিধি ৩০৪(খ) ধারায় চালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে তা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছিল। সঙ্গে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান। আইনের সংশোধনীতে জরিমানা কমিয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আদালত অর্থদণ্ডের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রদানের নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, আইনে কিছু কঠোর ধারা রয়েছে, যা মেনে চালক-শ্রমিকের পক্ষে গাড়ি চালানো মুশকিল। লেন ভাঙার জরিমানা ১০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত পণ্য বহনের জরিমানা তিন লাখ টাকা। এত টাকা একজন চালক কোথায় পাবে? এ কারণে সরকারের কাছে দাবি ছিল আইনটিকে বাস্তবসম্মত করা। খসড়ায় দাবির পুরোপুরি প্রতিফলন হয়নি।

আইনের ৪০ ধারা লঙ্ঘন অর্থাৎ গাড়ির আকার-আকৃতি পরিবর্তনের অপরাধে ৯৮ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ তিন বছর জেল এবং সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ধারায় পরিবর্তন না হলেও এ অপরাধকে জামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হরেছে। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করার অপরাধে ৯৮ ধারায় মামলাও জামিনঅযোগ্য। খসড়ায় এ দুটি ধারাকে জামিনযোগ্য করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ধারায় সংঘটিত অপরাধকে আপসযোগ্য করারও প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। তবে প্রাণহানির ক্ষেত্রে আগের মতো ১০৫ ধারা জামিনঅযোগ্য থাকবে। সড়ক আইনের এই একটি ধারাই জামিনঅযোগ্য রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা কমানোর দাবি করেছিলেন। আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, পেশাদার চালক হতে অষ্টম শ্রেণি পাস করতে হবে। সংশোধনের খসড়ায় বলা হয়েছে, তিন চাকার যানবাহনের পেশাদার চালক পঞ্চম শ্রেণি পাস করলেই লাইসেন্স পাবেন। বাস-ট্রাকের কন্ডাক্টর বা সুপারভাইজারের ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে পরীক্ষা দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন। তাদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা হয়নি। আইনের ১৪ ও ১৫ ধারা সংশোধন করে কন্ডাক্টরের সঙ্গে সুপারভাইজার পদটি যুক্ত করা হয়েছে। এ পদে কাউকে নিয়োগ দিলে নিয়োগপত্র দিতে হবে মালিককে।

ফিটনেসবিহীন গাড়িকে সনদ দিলে বিদ্যমান আইনের ২৫(২) ধারায় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইন সংশোধন করে দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে কর্মকর্তাদের। খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘কোনো অবস্থাতেই ত্রুটিপূর্ণ কোনো যানবাহনকে ফিটনেস সনদ প্রদান করা যাবে না।’ সনদ দিলে কর্মকর্তার কী শাস্তি হবে, তা বলা নেই।

লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে বিদ্যমান আইনের ৬৬ ধারায় ছয় মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ধারাটি সংশোধন করে জরিমানা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ধারা ৬৯ অনুযায়ী ভুয়া লাইসেন্স বানালে সর্বোচ্চ দুই বছর জেল এবং অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। সংশোধনের খসড়ায় ভুয়া বা জাল লাইসেন্সের জন্য অনধিক এক বছরের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাতিল হওয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালানোর জরিমানা ২৫ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ১০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

যাত্রীবাহী পরিবহনে সরকারনির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা নিলে বিদ্যমান আইনের ৮০ ধারা অনুযায়ী এক মাস কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। জরিমানা কমিয়ে পাঁচ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নিলে বিদ্যমান আইনে চালকের লাইসেন্স থেকে এক পয়েন্ট কর্তনের বিধান রয়েছে। তা বাদ দেওয়া হয়েছে খসড়ায়। সিএনজি অটোরিকশা বা ভাড়ায় চালিত গাড়ির মিটারে কারসাজির শাস্তি ছিল ছয় মাসের জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। জরিমানা কমিয়ে ২৫ হাজার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

আইনের ৮৫ ধারা অনুযায়ী ট্রাফিক সিগন্যাল (সংকেত) অমান্য করায় জরিমানা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। তা কমিয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে লাইসেন্স থেকে পয়েন্ট কাটার বিধান থাকছে। শব্দ ও বায়ুদূষণকারী গাড়িকে ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান সংশোধন করে পাঁচ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অবৈধ পার্কিংয়ের জরিমানা পাঁচ হাজার থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করার কথা রয়েছে। পার্কিং দখল করে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামার জরিমানা পাঁচ হাজার থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব হয়েছে। এ অপরাধে চালকের লাইসেন্স থেকে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কর্তনের শাস্তি বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ধারা ৮৬ অনুযায়ী সড়কের জন্য ক্ষতিকর ওভারলোডিংয়ে (ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্য বহন) সর্বোচ্চ এক বছর জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আইন সংশোধনের খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে গাড়ির মালিক, পণ্য বহনকারী প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদার ওভারলোডিং করলে সর্বোচ্চ এক বছর জেল বা এক লাখ টাকা জরিমানা হবে। তবে চালক এ অপরাধ করলে সর্বোচ্চ তিন মাস জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা হবে।

আইনের ৮৮ ধারা অনুযায়ী গাড়িতে নির্ধারিত মাত্রার অতিরিক্ত শব্দ সৃষ্টি করে এমন হর্ন বা যন্ত্রাংশ সংযোজনের শাস্তি তিন মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা। সংশোধনীর খসড়ায় তা কমিয়ে এক মাসের জেল বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ৮৯ ধারা অনুযায়ী পরিবেশ দূষণকারী ও ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি চালানোর শাস্তি তিন মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। সংশোধনীর খসড়ায় তা কমিয়ে এক মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে।

অতিরিক্ত পণ্যবাহী বা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে জীবন ও সম্পদের ক্ষতির শাস্তি আইনের ৯৮ ধারা অনুযায়ী তিন বছর জেল বা তিন লাখা জরিমানা। আইনের সংশোধনীতে একই শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ধারাটি আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে ওভারটেকিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটালেও একই শাস্তি হবে। চালক ও তার সহকারীর সঙ্গে সহায়তাকারীকেও আইনের আওতায় আনা হবে। অন্যান্য শাস্তি কমলেও দুর্ঘটনার পর গাড়ি ভাঙচুরের সাজা বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে সংশোধনীতে। ১০ হাজার টাকা জরিমানা দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সূত্র : সমকাল

উপদেষ্টা সম্পাদক: ডি. মজুমদার
সম্পাদক: মীর আক্তারুজ্জামান

সর্বস্বত্ব: এমআরএল মিডিয়া লিমিটেড
ঢাকা অফিস: মডার্ণ ম্যানসন (১৫ তলা), ৫৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০
ময়মনসিংহ অফিস: হাসনাইন প্লাজা (দ্বিতীয় তলা), ৭ মদন বাবু রোড, ময়মনসিংহ-২২০০
সেলফোন: ০৯৬১১-৬৪৫২১৫, ০৯৬৯৭-৪৯৭০৯০ ই-মেইল: jagrota2041@gmail.com
ফোন :
ইমেইল :