, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কর্মময় জীবন

  নিজস্ব প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কর্মময় জীবন

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, দেশের শীর্ষস্থানীয় বরেণ্য আলেম, ইলমি অঙ্গনে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী (৬৮) চট্টগ্রাম নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১২টা ৫০ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

একনজরে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী

কর্মময় জীবনে কেমন ছিলেন আল্লামা বাবুনগরী? তাঁর জন্ম, বেড়া ওঠা, শিক্ষাজীবনসহ কর্মক্ষেত্রে তার অবদান ও ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো-

> জন্ম ও পরিচয়

হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  তার বাবার নাম আবুল হাসান এবং মায়ের নাম ফাতেমা খাতুন। হারুন বাবুনগরী ছিলেন তার নানা। মায়ের দিক দিয়ে তার বংশধারা ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

> শিক্ষাজীবন

জুনায়েদ বাবুনগরী মাত্র ৫ বছর বয়সে নিজ গ্রাম বাবুনগরের আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। এ মাদরাসা থেকে তিনি মক্তব, কোরআনুল কারিম হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

কোরআন হেফজ সম্পন্ন করার পর তিনি আজহারুল ইসলাম ধর্মপুরীর কাছে পুরো কোরআন মুখস্থ শুনিয়েছিলেন।

অতঃপর মাদরাসা জগতের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মাঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সুনামের সঙ্গে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ‘দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স-এ) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।

তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম, মুফতি আহমদুল হক, মাওলানা আবুল হাসান, মাওলানা আব্দুল আজিজ এবং আল্লামা শাহ আহমদ শফীসহ প্রমুখ খ্যাতিমান আলেমের কাছে ইলমে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করেন।

উচ্চ শিক্ষা

হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিসে প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান গমন করেন। পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় ‘তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দীর্ঘ ২ বছর এ প্রতিষ্ঠানে ইলমে হাদিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেন।

অতঃপর তিনি আরবি ভাষায় ‘সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী’ (ইমাম দারিমী ও তার শিক্ষকগণের জীবন বৃত্তান্ত) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ (গবেষণা গ্রন্থ) জমা দেন। এই অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর তিনি জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন।

জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তিনি তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরী, ইদ্রিস মিরাঠী, আব্দুল্লাহ ইউসুফ নোমানীসহ অনেকের কাছে ইলমে হাদিসের জ্ঞান আরোহন করেন। পাশাপাশি তিনি ওয়ালী হাসান টুঙ্কির কাছে সুনান আত-তিরমিজি এবং মুহাম্মদ ইউসুফ বিন্নুরীর কাছে সহিহ বুখারি দ্বিতীয় বারের মত অধ্যয়ন করেন।

> তাসাউফের দীক্ষাগ্রহণ

শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করার পর আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৮ সালে আব্দুল কাদের রায়পুরীর উত্তরসূরী আব্দুল আজিজ রায়পুরীর কাছে বায়আত গ্রহণ করেন। রমজান মাসে তিনি রায়পুরীর খানকায় অবস্থান করে আব্দুল আজিজ রায়পুরীর কাছে কিছুদিন অবস্থান করে তার সান্নিধ্য লাভ করেন।

এছাড়াও তিনি আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহির দুই শিষ্য- আব্দুস সাত্তার, ফতেয়াবাদ, শাহ আহমদ শফী, রাঙ্গুনিয়া। আবুল হাসান আলী নদভীর শিষ্য সুলতান যওক নদভীর কাছ থেকেও খেলাফত ও ইলমে তাসাউফেরে শিক্ষা লাভ করেন।

> কর্মজীবন

১৯৭৮ সালের শেষের দিকে জুনায়েদ বাবুনগরী পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে নিজ গ্রাম বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়।

তিনি বাংলাদেশের মাদরাসা সমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন।

 ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। দীর্ঘদিন ইলমে হাদিসের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। পরবর্তীতে তিনি হাটহাজারী মাদরাসার সহকারি পরিচালক নিযুক্ত হন।

২০২০ সালের ১৭ জুন মাদরাসা কমিটি তাঁকে সহকারি পরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। তার স্থলে মাদরাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক শেখ আহমদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতঃপর তাকে হাটহাজারী মাদরাসার শাইখুল হাদিস এবং শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শত ব্যস্ততার মাঝেও শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আসছিলেন।

তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহ-সভাপতি, চট্টগ্রাম নূরানী তালীমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

> পরিবার

পারিবারিক জীবনে তিনি ৫ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক। ছেলের নাম মুহাম্মদ সালমান।

> লেখালেখি ও রচনায় তার অবদান

আরবি, উর্দু ও বাংলায় তার রচিত ও সম্পাদিত প্রায় প্রায় ত্রিশটি গ্রন্থ রয়েছে। তার লিখিত বইসমূহের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি হলো-

১. সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী (১৯৭৮);

২. বিশ্ববরেণ্যে মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি;

৩. তালিমুল ইসলাম (আরবি);

৪. বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত

৫. ইসলামে দাড়ির বিধান

৬. তাওহীদ ও শিরক: প্রকার ও প্রকৃতি

৭. মুকাদ্দিমাতুল ইলম : তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, ফতোয়া

৮. দারুল উলুম হাটহাজারীর কতিপয় উজ্জ্বল নক্ষত্র

৯. আকাবিরে দেওবন্দের সিলসিলায়ে সনদ

১০. জুনায়েদ বাবুনগরীর রচনাসমগ্র

১১. ইলমে হাদীসের ভূমিকা

১২. খুতবার ভাষা

১৩. মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (স.)

১৪. ইসলাম আওর সায়েন্স

১৫. নাস্তিক মুরতাদের শরয়ী বিধান

১৬. জাল হাদীস

১৭. সূরা ফাতিহা

১৮. মুকাদ্দামায়ে তানযীমুল আশতাত

১৯. খতমে নবুয়ত ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়

২০. সিয়াম সাধনা ইতেকাফ ও ঈদ মোবারক

২১. মিলাদ কিয়াম ও সুন্নাত বিদআত

> বক্তৃতা সংকলন

১. হক বাতিলের লড়াই

২. সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড

৩. ইলমে দ্বীনের গুরুত্ব ও ফজীলত

> তার তত্ত্বাবধানে লিখিত বই

১. ইসলাম বনাম সমকালীন মতবাদ

২. প্রচলিত জাল হাদীস: একটি তাত্ত্বিক আলোচনা

৩. ইসলামের দৃষ্টিতে গান-বাজনা

> আরবি পত্রিকা ও সাময়িকীতে তার অবদান

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী অনেক আরবি পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১.  দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার আরবি পত্রিকা আল বাসুল ইসলামি।

২. দারুল উলুম দেওবন্দের মাসিক পত্রিকা আদ দায়ী্

৩. দারুল উলুম হাটহাজারীর মাসিক আল মুঈন।

> মৃত্যু

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯ আগস্ট ২০২১ইং বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা ১২টা ৫০ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।

আল্লাহ তাআলা আল্লামা বাবুনগরীর কর্মজীবনকে কবুল করুন। জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

  • সর্বশেষ - অতিথি কলাম