আ.লীগের ভোটারও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন
প্রকাশ :
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ৫৪ লাখের বেশি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীরা মোট ভোট পেয়েছেন ৮ লাখ ৭১ হাজার। এবারের সিটি নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি। সেই হিসাবে প্রদত্ত ভোটের ৫৯ শতাংশ পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে ঢাকার দুই সিটির ভোটার সংখ্যার বিচারে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে মাত্র ১৬ শতাংশ।
অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের ভোটাররা এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজ
দলের প্রার্থীদের ভোট দিতে যাননি। রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদের অনেকেই
বলছেন, কয়েক বছর ধরে ভোটের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তাতে ভোটাররা ভোটবিমুখ
হচ্ছেন। ভয়ভীতিসহ নানা কারণে কেবল বিরোধী দলের ভোটাররাই নন, সরকারি দলের
ভোটাররা ভোট দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছেন না।
এরশাদের স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচন নিয়ে তেমন বড় ধরনের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নানা অভিযোগ থাকলেও ওই নির্বাচনেও দলটি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৪৮ শতাংশ। আর সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে। কেননা, সেখানে কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে ভূমিকা রাখেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিকে সম্পাদক এস এম কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার কমের ব্যাপারে দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ভূমিকা থাকে। মূলত, কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাঁদের কর্মীরা ভোটার আনেন। তাঁরা সেই কাজ পুরোপুরি করতে পারেননি। তা ছাড়া রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন সময় ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়া, কেন্দ্রের বাইরে লোক রাখাসহ বিভিন্ন কথা বলেছেন। এতে একধরনের ভীতি ভোটারদের মধ্যে ছিল। পাশাপাশি ঢাকা মূলত ভাড়াটেদের শহর। অনেকে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে যান, বন্ধের কারণে ঢাকা ছেড়েছেন, এমনটাও আছে। তা ছাড়া যানবাহন চলে না। সেটাও ভোটার কম হওয়ার কারণ।
যাঁরা নির্বাচন নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের মতে, মোট ভোটারের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ আওয়ামী লীগের ভোটার। এই পরিমাণ ভোট আওয়ামী লীগ সব সময়ই পেয়ে থাকে। সেই হিসেবে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ভোটার ন্যূনতম ১৯ লাখ। সেখানে এবার আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী মিলিতভাবে এর অর্ধেকের চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন।
তাই খোদ রাজধানীতে দলের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনাগ্রহ আওয়ামী লীগকেও ভাবনায় ফেলেছে। আজ রোববার বিকেলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, এবারের নির্বাচনে পরিবেশ ভালো ছিল। সব প্রার্থী ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। নির্বাচন ঘিরে ধরপাকড়, বড় ধরনের কোনো মারামারির ঘটনাও ছিল না। এরপর নতুন প্রযুক্তি ইভিএমে ভোট হয়েছে। সব মিলিয়ে ভোটারদের না আসার কারণটা খতিয়ে দেখা দরকার।
এই নেতা বলেন, রাজনৈতিক দলের কাজ ভোটারদের সঙ্গে, জনগণের সঙ্গে। তাঁদের বিমুখ হওয়াটা চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, গতকাল শনিবার ভোটের সময়ই দলীয় কার্যালয়ে তাঁরা এ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির ভোটাররা আসছে না, এটা আমাদের জন্য আত্মতৃপ্তির হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে যদি আমাদের একেবারে নিজস্ব (ডাইহার্ড) ভোটাররা বিমুখ হয়, সেটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো না। এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে। বোঝার চেষ্টা করা হবে কারণটা কী।’
গতকাল ভোটের মধ্যে কাঁঠালবাগান হাসান আদর্শ বিদ্যালয়ে কথা হয় আবদুল্লাহ আল আরেফিনের সঙ্গে। তিনি ভোট না দিয়েই চলে যাচ্ছিলেন। কারণ জানতে চাইলে ওই ভোটার বলেন, ‘ভবনের দোতলার ৪ নম্বর বুথে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, গোপন কক্ষে ভোটারের সঙ্গে একটি দলের ব্যাজ লাগানো এক ব্যক্তিও যাচ্ছেন। কোন প্রতীকে ভোট দিতে হবে, তা বলে দিচ্ছেন।’ আরেফিন আরও বলেন, ‘আমি “হয়তো” ওই প্রতীকেই ভোট দিতাম। কিন্তু ওই লোকের সামনে, ওই লোকের কথায় দিতে হবে, এই মানতে পারিনি। এর কারণে ভোটই দিইনি। চলে এসেছি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ মনে করেন, ভোট কম পড়েছে, এটা ঠিক। তবে এর পেছনে কারণ আছে। তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি দেখেছি, ৩০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে, যা অনেক বেশি হতো। ভোট কম হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কিছু কারণ যুক্ত। প্রথমত, পূজাসহ টানা তিন দিন ছুটি থাকায় অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। দ্বিতীয়ত, শুরু থেকেই ইভিএম নিয়ে বিএনপির নেতিবাচক প্রচারণা মানুষের মধ্যে ইভিএম নিয়ে একটি সংশয় তৈরি করেছে। তৃতীয়ত, বিএনপি বলছে, তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোটে এসেছে, জেতার জন্য নয়। এসব কারণে প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত একজন শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে আসেনি। এ কারণে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবেই জয় পায়। এরপর সে বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম তিন ধাপে ভোট সুষ্ঠু হয়েছিল। কিন্তু এরপর বাংলাদেশে আর সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে,তা বলা যাবে না। ফলে সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন,ভোট দিলেও যে ফল হবে, না দিলেও তা–ই হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররাও মনে করেন, ভোট দিতে না গেলেও তাঁদের প্রার্থী জয় পাবেন। ফলে তাঁরও ভোট দিতে যাচ্ছেন না।
ওই শিক্ষক বলেন, বিএনপির ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না এলে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যাবেন না। কেননা, সাধারণ ভোটাররা প্রতিযোগিতা নামেন। প্রতিপক্ষ মাঠে থাকলে বা ভোটকেন্দ্রে থাকলে অন্য পক্ষও ভোটকেন্দ্রে বা মাঠে থাকবে। নইলে ভোটার উপস্থিতি কমতে থাকবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে এখন নিজের ভোটারদের উজ্জীবিত করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকার দুই সিটিতে গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচনের মধ্যে বিএনপি ভোট থেকে সরে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকার দুটি আসনে ইভিএমে ভোট হয়। এই দুই আসনে ভোট প্রায় ৪৩ শতাংশের মতো পড়ে। বাকি আসনগুলোয় ভোটার উপস্থিতি ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশের মতো ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, ‘মানুষ এখন ভাবে, আমার কী লাভ হবে। ভোটে মানুষ লাভ খুঁজে পায় না। এখানে তার পাওয়ার কিছু নেই। ভোটে মানুষের উৎসাহ কমে গেছে। তবে এর নেপথ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা একইভাবে ক্রিয়াশীল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ‘২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচনের রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়েছে। এটি উঠতে সময় লাগবে। কাউকে দোষারোপ করে কাজ হবে না। সরকার হয়তো বিরোধী দলকে দায়ী করল, আবার বিরোধী দল সরকারি দলকে দায়ী করল—এভাবে ব্লেমগেমে বিষয়টির সুরাহা হবে না। সুশীল সমাজের একটি অংশের ব্যাখ্যা একেবারে গৎবাঁধা হয়ে গেছে। কয়েক বছর যাবৎ যে নির্বাচনী সংস্কৃতি চলছে, তার কারণে মানুষের উৎসাহ কমে যেতে পারে। আরেকটি কারণ হতে পারে, জাতীয় নির্বাচনকে মানুষ যত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, এ নির্বাচনকে তারা সেভাবে নিতে পারেনি। তবে দুই কারণের মধ্যে প্রথমটিই আমার কাছে বেশি জোরালো বলে মনে হয়।’