2024-05-05 01:46:24 am

১৫-১৭% জনসমর্থন নিয়ে মেয়র

www.focusbd24.com

১৫-১৭% জনসমর্থন নিয়ে মেয়র

০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২০, ১৫:৪৫ মিঃ

১৫-১৭% জনসমর্থন নিয়ে মেয়র

শেখ ফজলে নূর তাপস ও আতিকুল ইসলাম।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম মোট ভোটারের মাত্র ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়রের চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটারের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস।

ভোট পড়ার হার উত্তরে ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রার্থীকে। ভোটের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্রমে ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। তবে সর্বশেষ এই ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি একধরনের অনাগ্রহ তৈরি হতে থাকে। বিভিন্ন নির্বাচনে নানা অনিয়ম ও জবরদখলের ঘটনায় নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে। নির্বাচনব৵বস্থা ভেঙে পড়েছে। ফল নির্ধারণে ভোটারদের গুরুত্ব নেই—এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। এ কারণে বড় অংশের ভোটারের মধ্যে ভোটবিমুখতা তৈরি হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা ভোটের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার আরও কয়েকটি নতুন কারণের কথা বলছেন। যেমন মানুষ এখন গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়ে কিছুটা উদাসীন বা প্রত্যাশাহীন হয়ে পড়েছেন। ভোটের ফল নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। কারণ, এখানে তাঁদের পাওয়ারও কিছু নেই। তা ছাড়া মানুষ হয়তো কোনো ঝামেলায়ও জড়াতে চান না। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই এখন মানুষের কাছে প্রধান। এটাকেই বড় করে দেখছেন তাঁরা। বলা যায়, আস্থা বা নিরাপত্তাহীনতার কারণেই মানুষ গণতন্ত্রবিমুখ হয়ে পড়ছেন।

এক–তৃতীয়াংশ মানুষও কেন্দ্রে যাননি
গত শনিবার অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ঢাকা উত্তরে মোট ভোটার ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। ভোট দিয়েছেন ৭ লাখ ৬২ হাজার ১৮৮ জন। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মোট ভোটারের ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশের সমর্থন পেয়ে মেয়র হয়েছেন। অবশ্য তিনি প্রদত্ত ভোটের ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ পেয়েছেন।

গত বছরের মার্চে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু সে নির্বাচনেও ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আর এর আগে ২০১৫ সালে উত্তরের মেয়র নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৩ শতাংশ। বিএনপি মাঝপথে সে নির্বাচন বর্জন করেছিল।

এবার ঢাকা দক্ষিণে মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৫৯ জন। ভোট পড়েছে ৭ লাখ ১৩ হাজার ৫০টি। ৭১ শতাংশ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাননি। ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের মাত্র ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশের সমর্থন পেয়েছেন। তবে তিনি প্রদত্ত ভোটের ৫৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ পেয়েছেন।

২০১৫ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট পড়ার হার ছিল ৪৮ শতাংশ।

প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবারও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিল। প্রচারণায় দুই দলের প্রার্থীরা সরব থাকলেও এক–তৃতীয়াংশ ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যাননি। প্রথমবারের মতো পুরোপুরি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত। ভোটার যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলে অনেক জায়গায় অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা গোপন কক্ষে ভোট দিয়ে দেন। এই অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা সরকারদলীয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁরা ‘ভোট সহায়ক’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি আগ্রহ কমছে। মানুষ ভাবছে, ভোট দেওয়া না-দেওয়া সমান।

তবে দুই সিটির নির্বাচনকে ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। অবশ্য স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে গত মাসে চট্টগ্রাম–৮ আসনের উপনির্বাচন ছাড়া এত কম ভোট পড়ার নজির আর দেখা যায়নি। এ উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২৩ শতাংশ।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না করা, বিরোধী দলের সহিংসতা এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের অনীহার সূচনা ঘটে। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, অনিয়ম এবং ভোট কারচুপির ব্যাপক ও দৃশ্যমান অভিযোগ এবং এসব অভিযোগের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা ভোটারদের মধ্যে চূড়ান্ত হতাশা তৈরি করে। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে একটি দেশ উদার গণতান্ত্রিক থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের দিকে চলে যায়।

সাম্প্রতিক একটি জরিপের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ওই জরিপ অনুযায়ী প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছে। তাহলে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও কি ভোট দিতে যাননি? তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন নাকি তাঁরা ধরে নিয়েছেন, তাঁদের দল জয়ী হবে, এ কারণে ভোট দিতে হবে না।

অন্য সিটি নির্বাচনে ভোটের হার বেশি ছিল
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতেও ভোটের হার অনেক বেশি ছিল। রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭৮ শতাংশ, সিলেটে ৭৫ শতাংশ, বরিশাল ও খুলনায় ৬২ শতাংশ এবং গাজীপুরে ৫৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। অবশ্য সেসব নির্বাচনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সব জায়গায় বিরোধী দলের প্রার্থী ও কর্মী, ভোটার এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নানাভাবে চাপে রেখে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। বুথ দখল করে জাল ভোট, প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া, পুলিশের বাড়াবাড়ি বা পক্ষপাতমূলক ভূমিকা নিয়ে বিরোধী পক্ষগুলোর নানা অভিযোগ ছিল। কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ শতাংশ। তবে সে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক আছে। বিএনপির অভিযোগ, অনেকগুলো কেন্দ্রে ভোটের আগের রাতে আওয়ামী লীগ ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রেখেছিল। ওই নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল। এই নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কমতে থাকে।

দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে
বাংলাদেশে ভোট মানে উৎসব। দীর্ঘদিনের এই সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে। প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোটের সার্বিক আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু সেভাবে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। ভোটের প্রতি ভোটারদের অনাগ্রহ বাড়ছে।

ঢাকার দুই সিটিতে ভোটের হার নিয়ে ইসিও সন্তুষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ভোট পড়েছে। এই হারে তাঁরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। কেন কম ভোট পড়ল, তা গবেষণার বিষয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সুপারিশ থেকেও ভোটার উপস্থিতি কম থাকার কারণ জানা যেতে পারে।

ভোটারদের অনাগ্রহের পেছনে অনাস্থা রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর বলেন, ‘অনাস্থার কারণে যদি ভোটকেন্দ্রে না যেতেন, তাহলে যাঁরা সরকারি দলের, তাঁদের অন্তত ভোটে অনাস্থা থাকার কথা না। তাঁদের সব ভোটার যদি ভোট দিতেন, তাহলেও তো এত কম ভোট পড়ত না। তার মানে, তাঁদেরও অনেক ভোটার ভোট দিতে যাননি। আমি ভোট না দিতে গেলেও সমস্যা নেই—এ ধরনের একটা মনোভাব থেকে হয়তো অনেকেই ভোট দিতে যাননি।’

জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে। একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ও দশম সংসদ নির্বাচন বাদে অন্য সব জাতীয় নির্বাচনে ৫১ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে।

এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোটার–খরা দেখে একাধিকবার শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি এটিকে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত ইসি সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারেনি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দীন খান প্রথম আলোকে বলেন, ভোটের প্রতি আগ্রহ কমার কারণ মানুষ মনে করছেন, তাঁর ভোট দেওয়া না–দেওয়া সমান। বিগত জাতীয় নির্বাচন দেখে মানুষ প্রচণ্ড হতাশ। তিনি মনে করেন, ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে নতুন করে ভোট করতে হবে, এমন বিধান রেখে আইন সংস্কার করা দরকার। প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকা শহরের যে দুজন মেয়র নির্বাচিত হলেন, তাঁরা ৭০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর।


উপদেষ্টা সম্পাদক: ডি. মজুমদার
সম্পাদক: মীর আক্তারুজ্জামান

সর্বস্বত্ব: এমআরএল মিডিয়া লিমিটেড
ঢাকা অফিস: মডার্ণ ম্যানসন (১৫ তলা), ৫৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০
ময়মনসিংহ অফিস: হাসনাইন প্লাজা (দ্বিতীয় তলা), ৭ মদন বাবু রোড, ময়মনসিংহ-২২০০
সেলফোন: ০৯৬১১-৬৪৫২১৫, ০৯৬৯৭-৪৯৭০৯০ ই-মেইল: jagrota2041@gmail.com
ফোন :
ইমেইল :