১০ অক্টোবার ২০২২, ১৯:০৫ মিঃ
সুতার কাঁচামাল আমদানিতে দাম বেশি দেখিয়ে (অভার ইনভয়েসিং) অর্থপাচার করছেন। আবার বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে খোলা বাজারে অবৈধভাবে বিক্রি করছেন সুতা, প্লাস্টিক দানাসহ নানা পণ্য। সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ব্যবহার করে এমন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) বন্ধু সিদ্দিকুর রহমান ও তার সহযোগীরা।
২০২০ সাল থেকে এসব অপকর্ম চলছে। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সিদ্দিকুর রহমান। তিনি এখন পলাতক। অবস্থান করছেন পর্তুগালে। অবৈধ কর্মকাণ্ডে তাকে সহযোগিতা করছেন ছেলে নিয়াজ রহমান সাকিব, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সরোয়ারসহ একটি চক্র। তাদের কারণে গত দুই বছর ধরে বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে এসব অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের পদ হারানো লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আনিসুর রহমান। তার দাবি, অবৈধ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তাকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে— অভিযোগ আনিসুর রহমানের।
এখনও নিজেকে চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করা আনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার অবসরের সব সঞ্চয় সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজে বিনিয়োগ করেছি। ২০২০ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পি কে হালদার ও সিদ্দিকুর রহমানসহ পি কে গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে মামলা করে। তখনই পি কে হালদারের সঙ্গে সিদ্দিকুর রহমানও পালিয়ে পর্তুগালে চলে যান। তার স্থলে এমডি হিসেবে ছেলে সাকিবকে নিয়োগ দেন সিদ্দিকুর।
‘আমি ছিলাম চেয়ারম্যান। ভালোই চলছিল। কিন্তু অর্থপাচার রোধ ও জালিয়াতি করতে না দেওয়ায় আমার ওপর ক্ষেপে যান সিদ্দিকুর। দীর্ঘদিন ধরে বাবার সঙ্গে পর্তুগালে থাকা সাকিবকে সম্প্রতি দেশে আনা হয়। তিনি (সাকিব) দেশে এসে বাবার পরিকল্পনা অনুসারে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা সরোয়ার ও পি কে গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে আমাকে পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। পদত্যাগ না করায় আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। পরে তারা আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে আমার জায়গায় নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। আমাকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বের করে দেওয়া হয়।’
এটা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এর মালিকানা দেশের জনগণের। জনগণের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানটিকে পি কে গ্রুপের হাত থেকে রক্ষার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি— জানান আনিসুর রহমান।
এ বিষয়ে সিমটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়াজ রহমান সাকিবের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে, প্রতিষ্ঠানটির সচিব আশিস কুমার সাহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আনিস সাহেব আগে কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন আর তিনি চেয়ারম্যান নন। তিনি গুন্ডাপান্ডা নিয়ে এখানে মারামারি করেছেন। এতে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।’
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বিষয়ে বিএসইসি কমিশনার অধ্যাপক শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটি পক্ষ আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি নিজে চেয়ারম্যান বলে দাবি করেছেন। জয়েন্ট স্টকেও চেয়ারম্যান হিসেবে তার নাম রয়েছে বলে শুনেছি। বিষয়টি জানার জন্য উভয় পক্ষকে ডেকেছি। দুই পক্ষের শুনানি ও জয়েন্ট স্টকের সনদ পেলেই বলতে পারব প্রতিষ্ঠানটির কী অবস্থা।’
‘প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে ভাসাভাসা জানি। এখন কে দায়ী, কারা কী করেছে— বিষয়গুলো জানার জন্য উভয় পক্ষের কথা শুনতে হবে। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
৫ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন
২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত হলেও ২০১৬ সালে প্রথম শেয়ারহোল্ডারদের ২২ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হয়। ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি ভালো মুনাফা করে। এ তিন বছরে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ২ টাকা ৫২ পয়সা, ২ টাকা ২২ পয়সা এবং ২ টাকা ০১ পয়সা। শেয়ারহোল্ডাররা ১২, ২০ ও ১৪ শতাংশ লভ্যাংশ পান।
এরপর মুনাফায় ধস নামে। ১৫ কোটি টাকা থেকে মুনাফা নেমে আসে চার কোটি টাকায়। অর্থাৎ ২০২০ সালে মুনাফা দেখানো হয় চার কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ওই বছর শেয়ারহোল্ডারদের মাত্র ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া হয়। পরের বছর মুনাফা দেখানো হয় সাত কোটি টাকা। লভ্যাংশ দেওয়া হয় মাত্র ৪ শতাংশ।
চেয়ারম্যান দাবিদার আনিসুর রহমানের যত অভিযোগ
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান দাবিদার আনিসুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেছি। এ সময়ে যে ব্যবসা হয়েছে তাতে চলতি বছর শেয়ারহোল্ডারদের ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া যাবে। প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার না হলে, আত্মসাৎ না হলে বিনিয়োগকারীরা ভালো লভ্যাংশ পাবেন।
বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে সিদ্দিক যিনি সিমটেক্সের স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনিই পি কে হালদারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ৩৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের সহযোগী। সিদ্দিক এক সময় সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এমডি ছিলেন এবং তিনি এখনও সিমটেক্সকে বিদেশ থেকে পরিচালনার চেষ্টা করছেন। পি কের সহযোগী হওয়ায় তার নামে দুদক ১২ থেকে ১৩টি মামলা দায়ের করে। এ কারণে তিনি লুকিয়ে ভারত হয়ে পর্তুগালে চলে যান।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার এজাহারে দেখা গেছে, পি কে হালদার সিমটেক্সে ২৩ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার ২৭০ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তার সহযোগী সিদ্দিকুর রহমান, সিদ্দিকের স্ত্রী মাহফুজা রহমান, তাদের দুই ছেলে নিয়াজ রহমান সাকিব ও ইশতিয়াক রহমান ইমরান এবং সিদ্দিকের বড় ভাই এনসান আলি শেখের নামে।
‘পি কে হালদারের দেশত্যাগের পরপরই সিদ্দিকুর রহমান একই কায়দায় পালিয়ে যান। তারপর আমি পরিচালক হিসেবে নাবিক ছাড়াই সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের নৌকার হাল ধরি। প্রতিষ্ঠানটির দুঃসময়ে চেয়ারম্যান হয়ে সব ব্যাংক ও অফিসের সিগনেটরি হিসেবে কাজ করছি। ইতোমধ্যে নানা ঘটনা-অঘটনা ঘটে গেলেও এখনও আরজেএসসি-এর ডকুমেন্ট ও আদালতের আদেশ অনুযায়ী সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের একজন শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর ও চেয়ারম্যান আমি।’
চিঠিতে আনিসুর রহমান আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগের ২০২১ ও ২০২২ সালের রিট পিটিশন অনুযায়ী, আমি একজন নিবন্ধিত শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এবং সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান। যা ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রারের অফিস, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মস-এ প্রকাশিত। সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সঠিক অবস্থানে থাকায় এ মুহূর্তে এটি পরিবর্তন করা যাবে না বলে রিট পিটিশনে বলা আছে।’
‘সিদ্দিকুর রহমান কোম্পানি থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছেন এবং এখনও নিয়ে যেতে যাচ্ছেন। সিমটেক্স একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ায় এখান থেকে অবৈধভাবে টাকা নেওয়া, বন্ডের সেলাই সুতা, প্লাস্টিক দানা ও অন্যান্য দ্রব্য অবৈধভাবে বিক্রি করা এবং নানা অনিয়মে বাধা দিলে তাতে বাঁধ দেন সিদ্দিক ও পি কে হালদার গ্রুপের লোকজন। সিদ্দিক পি কে হালদারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী, তাদের অপর সহযোগী সরোয়ার যিনি নারীঘটিত কারণে কিছুদিন আগে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। সরোয়ার এর আগে বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করেছেন। তার ওপর ভর করে পি কে হালদার গ্রুপ মাথায় চেড়ে বসে।’
‘সম্প্রতি সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে সাকিবকে পর্তুগাল থেকে দেশে আনা হয়েছে। সাকিবকে সামনে রেখে সরোয়ার ও পি কে গ্রুপের সদস্যরা আমাকে হুমকি দিয়ে পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলে। আমি পদত্যাগ না করায় জীবনের হুমকি দেয়। এজন্য আমি আইনের আশ্রয় চেয়ে সভার থানায় জিডি করি।’
চিঠিতে তিনি আরও অভিযোগ করেন, গত ১৭ আগস্ট কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সিমটেক্সের ওয়েবসাইট থেকে আমার নাম, ছবি ও পদ মুছে ফেলা হয়। অথচ আরজেএসসি (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর) ও আদালতের আদেশ অনুযায়ী আমি এখনও সিমটেক্সের শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও চেয়ারম্যান। সিদ্দিকের ছেলে সাকিব ও পি কে হালদার গ্রুপের নেপথ্যে যারা কাজ করছেন তাদের কারণে আমার জীবন আজ হুমকির মুখে। আইন অনুযায়ী সরকারি সব সংস্থার সাহায্য কামনার পাশাপাশি আরজেএসসি ও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজ পদে বহাল রাখতে অনুরোধ করছি।
‘আমি ট্রাস্ট ব্যাংকের মিলিনিয়াম শাখায় সিমটেক্সের সব অ্যাকাউন্টের সিগনেটরি। আমার অনুপস্থিতিতে কীভাবে ট্রাস্ট ব্যাংক অর্থ আদান-প্রদান করছে? আমি ও নিয়াজ রহমান সাকিব ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কোনো পরিচালক বৈধ নন। কারণ, পি কে গ্রুপের সদস্যরা যাদের পরিচালক নির্বাচিত করেছেন, নিয়ম অনুসারে ২ শতাংশ করে দুজনের ৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হয়; কিন্তু তাদের দুজনের মিলে ২ শতাংশের কিছু বেশি শেয়ার রয়েছে। যা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। তাই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি সিমটেক্সকে ভয়ংকর অর্থ আত্মসাৎকারী পিকে হালদার গ্রুপের হাত থেকে বাঁচানোর অনুরোধ করছি।’
অভিযোগের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) লিস্টিং বিভাগের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। জবাব আসলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সর্বস্বত্ব: এমআরএল মিডিয়া লিমিটেড
ঢাকা অফিস: মডার্ণ ম্যানসন (১৫ তলা), ৫৩ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০
ময়মনসিংহ অফিস: হাসনাইন প্লাজা (দ্বিতীয় তলা), ৭ মদন বাবু রোড, ময়মনসিংহ-২২০০
সেলফোন: ০৯৬১১-৬৪৫২১৫, ০৯৬৯৭-৪৯৭০৯০
ই-মেইল: jagrota2041@gmail.com
ফোন :
ইমেইল :