, ৮ আশ্বিন ১৪৩০ অনলাইন সংস্করণ

গফরগাঁওয়ে বহু দুর্নীতিসহ ১০ অভিযোগে মেয়রকে অনাস্থা : যেকোনো সময় বরখাস্ত

  বিশেষ প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

গফরগাঁওয়ে বহু দুর্নীতিসহ ১০ অভিযোগে মেয়রকে অনাস্থা : যেকোনো সময় বরখাস্ত
আলোচিত এক জনপদের নাম গফরগাঁও। এই পৌরসভার মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন সুমনের বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতিসহ ১০ অভিযোগে মন্ত্রণালয়ে অনাস্থা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররা। অভিযোগের তদন্ত চলছে। যেকোনো সময় মেয়র সুমন বহিষ্কার হতে পারেন বলে বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। মেয়র, তার পিএস নামের প্রধান দেহরক্ষী ও ক্যাডারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ২ দফায় দীর্ঘ ৭ বছর দায়িত্ব পালন করে মেয়র অর্ধ শত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে অনাস্থা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ৭ বছরে মেয়রের প্রধান দেহরক্ষী তাজমুন আহমেদ নামে-বেনামে ৫০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুর্নীতিগ্রস্ত ও সমালোচিত মেয়র সুমনের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া ৭ বছরে বহুবার বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে তিনি মানি লন্ডারিংয়ের সাথেও জড়িত। বিষয়টি দুদকে তদন্তাধীন। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে মেয়র সুমন পৌর ভবনে অবস্থান, চলাফেরা এবং বহরে ব্যবহার করতেন অবৈধ ওয়াকিটকি। হোন্ডা বাহিনী নিয়ে দাঁপিয়ে বেড়াতেন উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকা। পৌর ভবনকে বানিয়ে ছিলেন টর্চার সেল। মেয়র সুমন ও তার বাহিনীর মতের বিরুদ্ধে গেলে বা কথা বললেই ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। সেলের দায়িত্ব পালন করতেন পৌর যুবলীগের যুগ্ন আহবায়ক তাজমুন আহমেদ। অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়া এবং অনাস্থা প্রস্তাবের পর মেয়র তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে আত্মগোপন করেন। এর পর তিনি আর গফরগাঁও যাননি। বেড়েছে নাগরিক দুর্ভোগ। সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে নাগরিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার মেয়রের সাথে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
অনাস্থা প্রস্তাবে বলা হয়, এস এম ইকবাল হোসেন সুমন নৌকা প্রতীক নিয়ে ২০১৬ সালে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০২১ সালের নির্বাচনে আবারও তাকে বিজয়ী করা হয়। দীর্ঘ ৭ বছরে তিনি আত্মসাতের পাশাপাশি অর্ধশত কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করেন। স্থানীয় এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের নাম ভাঙ্গিয়ে বীরদর্পে অনিয়ম, দুর্নীতি ও আত্মসাত চালান। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া ২০১৮ সালে উন্নয়নমূলক কাজের ৬২ টি প্যাকেজ বানিয়ে সাড়ে ৬ কোটির বেশি টাকার দরপত্র আহ্বান করেন। পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে নামমাত্র কাজ করিয়ে অধিকাংশ টাকা আত্মসাত করেন। ঠিকাদারের কাছ থেকে নেওয়া কমিশনের আগাম টাকাও মেরে দেন মেয়র সুমন। পৌরভবনের আশপাশ মাটি ভরাট প্রকল্প দেখিয়ে আত্মসাত করা হয় প্রায় ৬৭ লাখ টাকা। দিনের পর দিন রাজধানী ঢাকায় ব্যক্তিগত কাজে পৌরসভার গাড়ি ব্যবহার এবং জ্বালানি খরচ করে ৭ বছরে পৌর তহবিলের অর্ধ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করেন। পৌরসভার আয়তন অনুযায়ী মাষ্টাররোল কর্মচারী থাকার কথা ১৬ জন। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন অর্ধশত। এভাবেই ৭ বছরে পৌরসভায় লাখ লাখ টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এমপির নাম ভাঙ্গিয়ে প্রভাব বিস্তার এবং প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলরদের ভয়ভীতি দেখিয়ে গত ৭ বছর পৌর পরিষদের কোনো সভা করা হয়নি।

সূত্র জানায়, মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন সুমন তার প্রধান দেহরক্ষী তাজমুন আহমেদকে পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক বানানোর পাশাপাশি পিএস হিসেবে নিয়োগ দেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাজমুন পৌরসভায় মাস্টাররোলে চাকরি করার পাশাপাশি মেয়রের গোপন ও প্রকাশ্য বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। পৌরসভার অধিকাংশ কাজ করে তাজমুনের মালিকানাধীন ‘টিপু সেভেন এক্সেসরিজ’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। নিম্নমানের কাজ করে বিল উত্তোলনের পর মেয়র ও তাজমুন ভাগাভাগি করে নেন। তাজমুনের ভাইও পৌরসভার মাস্টাররোলের কর্মচারী। এদের জ্বালায় অতিষ্ঠ পৌর শহরের অধিকাংশ মানুষ। এদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছে দখল, চাঁদাবাজি ও ইয়াবা ব্যবসার একাধিক সিন্ডিকেট। তাজমুন বাহিনীর ক্যাডার সংখ্যা শতাধিক। তাদের বহরে রয়েছে ৪০ টির বেশি মোটর সাইকেল। ৭ বছর আগেও তাজমুন টোকাই ছিলেন। করতেন বিএনপি নেতাদের ফুটফরমাস। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিলো দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। সুমনের সাথে যুক্ত হওয়ার পর তাজমুন বিত্ত-বৈভবের মালিক হতে থাকেন। এখন নামে-বেনামে অধশর্ত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। ফ্ল্যাট, বাড়ি, একাধিক জমি, ব্যাংকে এফডিআর রয়েছে তাজমুন ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে। প্যানেল মেয়র-১ মোঃ শাহাজাহান সাজু ও প্যানেল মেয়র-২ আরিফুল ইসলাম ভূঁঞা বৃহস্পতিবার দৈনিক জাগ্রত বাংলা’কে বলেন, দুর্নীতির দায়ে মেয়র এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ও রুটিন কাজে সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে আমরা অনাস্থা প্রস্তাব করেছি। নাগরিক স্বার্থ ও পৌরসভার স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য দ্রুত সময়ে মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তারা বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতি করে গফরগাঁও পৌরসভার অনেক কর্মচারী এখন বাড়ি-গাড়ির মালিক।
সূত্র জানায়, মেয়র সুমনের সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি আড়াল করে রাখতেন পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একদল চিহ্নিত কর্মচারী। স্থানীয় এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল-এর বিরুদ্ধে করা গোপন ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার পর কপাল পুড়ে মেয়র সুমনের। স্থানীয় তদন্তে মেয়রের ষড়যন্ত্র, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরই ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। অথচ স্থানীয় এমপি এতদিন ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছিলেন মেয়র সুমনকে। বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ফুঁসে ওঠেন পৌরবাসী। একেক করে বের হতে থাকে সুমনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও আত্মসাতের যত ঘটনা। জনরোষ থেকে বাঁচতে মেয়র তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে গফরগাঁও ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। সূত্র মতে, মেয়র সুমন এমপির আস্থাভাজন হয়ে গফরগাঁও আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে প্রভাব বিস্তার করেন। অনিয়ম, দুর্নীতির ও আত্মসাতের বিষয় আড়াল করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। গড়ে তুলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাজমুন আহমেদকে। জমি কেনা-বেচা, বাড়ি করা, পরিবহন ও বালু মহাল নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ সব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাজমুন বাহিনীর হাতে। এই বাহিনীর হয়ে যায় গফরগাঁও পৌর শহর। এদের ভয়ে তটস্থ থাকেন পৌরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর ও কর্মচারীরা।


  • সর্বশেষ - আলোচিত খবর