ইভটিজিং রোধে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও প্রতিকার
প্রকাশ :
মো. সোহেল রানা
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই কিছু মানবাধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আলো, বাতাস, পানি, জীবনযাপনের অধিকার ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। কালের পরিক্রমায় সমাজে ইভটিজিং নামের অভিশাপের আবির্ভাব হয়। ফলে নারী নিজেদের সংকীর্ণ, অনিরাপদ ও কৃত্রিম বেড়াজালে আবদ্ধ মনে করেন ও ভীতি সৃষ্টি হয়। নারী ও অভিভাবকের মধ্যে ইভটিজিং কথাটি শুনলেই ভয়ের সৃষ্টি হয়।
প্রতিনিয়ত নারী কোনো না কোনোভাবে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কিশোরীরা অনুভব করেন, তাদের মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হবে। আমাদের ক্রমাগত উন্নতির পেছনে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ইভটিজিংয়ের কারণে তাদের অবদান হুমকির মুখে। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে সব স্থানেই নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। ইভটিজিং তাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল করে তোলে।
ইভটিজিং বলতে মূলত নারীদের উত্ত্যক্ত করাকে বোঝায়। নারীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাঁধা সৃষ্টি করাকে বোঝায়। যে কাজগুলো ইভটিজিং বলে বিবেচিত হয়; তা হচ্ছে- অশ্লীল মন্তব্য, গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, উস্কানিমূলক হাততালি, উদ্দেশ্যপূর্ণ যৌন আবেদনময়ী গান, কবিতা ও ছড়া পাঠ, অশ্লীল চিত্র প্রদর্শন, বিকৃতভাবে ডাক দেওয়া, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কু-প্রস্তাব, ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে এমন মন্তব্য, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে হুমকি, কর্মস্থলে নেতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
পাবলিক প্লেসে, যানবাহনে, রাস্তাঘাটে, নারীদের কর্মসংস্থানে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, হাসপাতালে নারীরা প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। মূলত যেখানে নারী রয়েছে; সেখানেই কোনো না কোনোভাবে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। মধ্যবয়সী পুরুষের দ্বারা নারীরা সবচেয়ে বেশি ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। ইভটিজিংয়ের পেছনে মাদক, নৈতিক শিক্ষার অভাব, সুষ্ঠু জ্ঞানের অভাব, নারীদের ভোগ্যপণ্য মনে করা ইত্যাদি মন-মানসিকতা রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় নারী বা তরুণী অনলাইনে যুক্ত আছেন। অনলাইনে তারা অনেক সময় অতিবাহিত করে থাকেন। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন। সেখানে নারীরা যথেষ্ট নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকেন। যারা অনলাইনে যুক্ত আছেন, তাদের অধিকাংশই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত অশ্লীল মন্তব্য, এসএমএসের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছেন। তাদের অশ্লীল প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। রাজি না হলে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় খারাপ ছবি বা ভিডিও দেওয়া হচ্ছে।
আমরা জানি, নারীকে পর্নোগ্রাফি প্রদর্শন করাও ফৌজদারি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার প্রেমের সম্পর্ক থাকা অবস্থায় নিজেদের খারাপ ছবি বা ভিডিও আদান-প্রদান করে সম্পর্কের টানাপড়েনে সেগুলো দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার নজিরও অনেক। এ ক্ষেত্রে ব্ল্যাকমেইল ইভটিজিংয়ের পর্যায় পড়ে। অনেক কিশোরী ব্ল্যাকমেইল বা ছবি বা ভিডিও প্রকাশিত হলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সুতরাং এসব প্লাটফর্মে বেশি নিরাপত্তা থাকা জরুরি। নারীরও সতর্ক হওয়া উচিত।
কিশোরীরা সর্বপ্রথম নিকটাত্মীয় (চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো ভাই ও অন্যান্য) বা মহল্লার সদস্য দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। স্থানগুলো নারীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা ছিল। নারীর চাকরি, সামাজিক কর্মকাণ্ড, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ সব স্থানে নির্বিঘ্নে নিরাপত্তার সাথে বিচরণ করতে পারে, এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কারণ আমাদের মোট জনশক্তির অর্ধেক নারী। অর্ধেক জনশক্তিকে ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। বৃহৎ জনশক্তি ব্যবহারহীন হয়ে পড়ে থাকতে দেওয়া মঙ্গলজনক নয়। সেজন্য প্রয়োজন নিরাপত্তার সাথে নারীর বিচরণ করতে পারার নিশ্চয়তা।
নিরাপদে বিচরণ করা সব মানুষেরই সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদে সব ব্যক্তিকে আইনগত বাধা-নিষেধ ব্যতীত চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ-৩২ এ বলা হয়েছে, ‘আইন ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না। নিরাপদে চলাচল ও জীবনযাপন, জীবিকা নির্বাহ প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার।’ এ অধিকার সবার। নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ভেদাভেদ শুধু দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাই সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে নারীর সব সেক্টরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দেশের উন্নতিতে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তারপরও যদি কেউ ইভটিজিং করে থাকেন। তাহলে তাদের প্রতিহত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজকের ইভটিজার আগামী দিনের ধর্ষক।
ইভটিজিং রোধে, নারীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য নিচের আইনগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখবে-
১.
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০২ এর ধারা-১০ এ বলা হয়েছে, ‘যদি কোন
ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে তার শরীরের যেকোন
অঙ্গ বা কোন বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোন অঙ্গ
স্পর্শ করে বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানী করে। তাহলে এই কাজ হবে ‘যৌন পীড়ন’
এবং তার জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ বৎসর কারাদণ্ড কিন্তু অন্যূন ৩ বছর
সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে এবং তার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
২. দণ্ডবিধি-১৮৬০ ধারা-২৯৪ এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি অন্যের বিরক্তির সৃষ্টি করে; (ক) কোন প্রকাশ্য স্থানে কোন অশ্লীল কাজ করে। অথবা (খ) কোন প্রকাশ্য স্থানে বা কোন প্রকাশ্য স্থানের সন্নিকটে কোনরূপ অশ্লীল সংগীত, গাথা বা কথা, গীত করে, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে। তবে সেই ব্যক্তি ৩ মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
৩. দণ্ডবিধির ধারা-৩৫৪ মতে, ‘কোন ব্যক্তি যদি কোন নারীর শ্লীলতাহানীর উদ্দেশ্যে তার উপর আক্রমণ করে বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে অথবা এইরূপ করার ফলে সংশ্লিষ্ট নারী শালীনতা হানী হতে পারে জানিয়া সত্ত্বেও তার উপর উপরোক্ত আক্রমণ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে। তবে সেই ব্যক্তি ২ বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
৪. দণ্ডবিধির ধারা-৫০৯ এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোন নারীর শ্লীলতাহানীর উদ্দেশ্যে সে নারী যাতে শুনতে পায় এমন কোন কথা বলে বা শব্দ করে অথবা সেই নারী যাতে দেখতে পায় এমনভাবে কোন অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে অথবা অনুরূপ নারীর গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে। তবে সে ব্যক্তি এক বৎসর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইভটিজিং ফৌজদারি অপরাধ যা শাস্তিযোগ্য। তবে এ আইনের প্রয়োগ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে ইভটিজিংয়ের হার হ্রাস পেত। কিন্তু সেটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইভটিজিংয়ের ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে। তাই অনেক সময় অপরাধীদের পরিচয় অজানা থেকে যায়। অনেক সময় ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করেন না। ইভটিজিং রোধে হটলাইন নাম্বার তৈরি করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ইভটিজিং রোধ করা যেতে পারে। এটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
এ ক্ষেত্রে ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে বা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সেবা পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়াও পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ব্যক্তিবর্গ সচেতনতা সৃষ্টি ও আইনগত প্রতিকার সম্পর্কে সচেতনা সৃষ্টি করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। ইভটিজিং বিরোধী প্রোগ্রাম ও কাউন্সিলিং করাসহ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অপরাধীদের প্রতিহত বা প্রতিরোধ করার জন্য অবশ্যই নারীকে রুখে দাঁড়াতে হবে। অভিযোগ করতে হবে। তাছাড়াও নারীর আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
তাই অনিশ্চিত নিরাপত্তার অবস্থান থেকে বের হয়ে ইভটিজিং সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা হোক। না হয় অপরাধীদের প্রতিহত বা প্রতিরোধ করে নারী সমাজকে একটি সুরক্ষিত বেষ্টনী তৈরি করে নিরাপদ সমাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।