, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

শ্যামল কান্তি ধরের গল্প ‘কাউট্টা’

  সাহিত্য ডেস্ক

  প্রকাশ : 

শ্যামল কান্তি ধরের গল্প ‘কাউট্টা’

পুকুরটা তেমন বড় নয়। চারিদিকে লেবুগাছ। কয়েকটি লেবু ছুঁয়ে আছে পুকুরের পানি। একটি মাছরাঙা বসে আছে লেবুগাছের ডালে। পৌষ মাস শেষ হতে চলছে। প্রকৃতি শীতের তীব্রতার কাছে বন্দি হয়েও সবুজ। পুকুরের কোণে খেজুর গাছটি এখনো পূর্ণতা পায়নি। এরই নিচে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে ঠান্ডায় কাঁপছে বাবুল। গতরাত তার ভালো ঘুম হয়নি। শীতের সাথে যুদ্ধে সে প্রতিনিয়ত পরাজিত। ভোর হতেই তার আর বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগেনি। বাড়ির সামনে পুকুরটি একদিন তার ছিল। মাছের খামার করার জন্য কয়েকবছর আগে শিবুল মেম্বার পুকুরটি লিজ নিয়েছিল। হাতে কিছু নগদ টাকা পেয়ে বাবুল একটি ছোট নৌকাও কিনেছিল। ভাঙা নৌকাটি এখন উঠানে উল্টো করে রাখা আছে। বর্ষার পানি আসার আগ পর্যন্ত নৌকাটি এভাবেই থাকবে।


কিছু শুকনো পাতা জড়ো করে তাতে আগুন লাগিয়ে উত্তাপ নিচ্ছিল বাবুল। রাস্তার পাশের খাল ভর্তি হয়ে আছে ধুসর শুকনো পাতায়। বাড়ির পাশের রাস্তাটি পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে দূরের ঐ নদীটির সাঁকো পর্যন্ত। খালের শুকনো পাতায় অনেকক্ষণ ধরে মচমচ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আগুন পোহাতে ব্যস্ত বাবুল শুনছিল তা। হঠাৎ এই শব্দটি খুব চেনা মনে হয় তার কাছে। শব্দের উৎসের কাছে এগিয়ে যায় সে। একটি বড় কচ্ছপ পাতার স্তর ভেদ করে উপরে উঠতে চাচ্ছে। ধীর গতিতে এগোনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পাতায় জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার। অনেকদিন পর এরকম দৃশ্য চোখে পড়ল বাবুলের। শীতের কাঁপুনি থেমে গিয়ে তার শরীরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল। আর দেরী করল না সে। অনেকদিন পর অপ্রত্যাশিত সুযোগটি গ্রহণ করল। কচ্ছপটি উল্টিয়ে মাথায় তুলে নেয়। অনেক ওজন। মনে মনে বাজারে এর দামের হিসাব কষে সে। নেহাত মন্দ নয়। তবে সে এটা বাজারে নেবে না। মজুমদার বাড়ি নিয়ে যাবে। ভালো দাম পাওয়া যাবে। ধান-চালের আড়তদার ঋশিকেশ মজুমদারের বাড়ি এই গ্রামের একমাত্র ধনি বাড়ি। সেই বাড়িতে কাজ করে তার স্ত্রী প্রতিমা।


পুকুর পেরিয়ে এক চিলতে উঠান। এর পরই প্রায় ভেঙে পড়া ঘর। ক্ষয়ে যাওয়া মাটির বারান্দা। ঘুণে ধরা বাঁশের খুঁটি। কচ্ছপটাকে উঠানে রেখে বাবুল বারান্দায় বসে। কুয়াশা যেন পুরো বাড়ি ঘিরে ধরেছে। কুয়াশার ভেতর সূর্যটাকে কেমন রূপালি লাগে বাবুলের কাছে। যেন নরম চাঁদ। বারান্দায় রাখা শীতলপাটির উপর শুয়ে পড়ে সে। কচ্ছপটি উঠানে এদিক ওদিক ঘুরছে। পাশের খাল থেকে ভেসে আসছে একঝাঁক হাঁসের বয়ে চলার শব্দ। যেন এক হাঁসের নদী। কাঁথাটিকে আরও ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নেয় বাবুল। গভীর ঘুম তাকে আচ্ছন্ন করেছে। হাসের প্যাঁক প্যাঁক ডাক ক্রমেই দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

২.

প্রতিমার ঘুম সাধারণত খুব ভোর বেলা ভাঙে। ঘুম থেকে জাগার পর সে বিছানায় আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। তখন সে ভাবে। সংসারের কথা ভাবে। মজুমদার বাড়িতে সে কাজ করে বিকেল পর্যন্ত। তাই কাজে যাওয়ার আগে, এই সময়টুকু সে নিজের মত গড়ে তোলে। আজ ঘুম ভাঙে তার একটু সময় করে। তীব্র ঠান্ডায় তার জ্বর জ্বর লাগছে। সারা শরীর ও গলায় একটু ব্যথাও অনুভব করে। পাশ ফিরে থাকায়। বাবুল পাশে নেই। তাদের একমাত্র ছেলে সুনীল গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে আছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে প্রতিমা বারান্দায় আসে। সুনীল মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে মাথাটা কাঁধে এলিয়ে দেয়। বারান্দার কোণে ঘুমন্ত বাবুলকে দেখে খুব মায়া হয় প্রতিমার। বাবুলের পাশে বসে প্রতিমা। ঘুমিয়ে যাওয়ার সময় কচ্ছপটির কথা মনে ছিল না বাবুলের। কচ্ছপটি নিজেকে মুক্ত মনে করে উঠানে কয়েক চক্কর দিয়ে পাশের ঝোপের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। সুনীলের চোখ সেখানে আটকে যায়, সে চিৎকার করে উঠল, ‘কাউট্টা, কাউট্টা’। প্রতিমা ছুটে যায় ঝোপের কাছে।

তখন শীতের সকালের নরম রোদ উঠান স্পর্শ করেছে। এক চিলতে রোদ বাবুলের সমান্তরালে গিয়ে ঘরের বাঁশের তৈরি দেয়ালে আটকে গেছে। কিছু অংশ ঘরের ভেতরেও প্রবেশ করেছে। রোদের মিষ্টি গরমের আঁচ পেয়ে ঘুম ভাঙে বাবুলের। ঘুম ভেঙেই দৃশ্যটি দেখে তার মন ভালো হয়ে যায়। প্রতিমা ও সুনীল কচ্ছপটিকে নিয়ে মেতে আছে। প্রতিমা কচ্ছপের পিঠে সওয়ার করেছে সুনীলকে। সুনীল তাতে মজা পেয়ে উল্লাস করছে, ‘কাউট্টা, কাউট্টা’। মাঝে মাঝে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। উঠানের ধুলা সারা গায়ে মাখামাখি। প্রতিমার গালে এক চিলতে রোদ, ছেলের গায়ে ধুলা কিছুক্ষণের জন্য বাবুলের মনে সুখ এনে দেয়। প্রতিমা বাবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘অউ ঝোপ থাইক্কা পাইছি।’ বাবুল মনে মনে হাসে। কিছু বলে না। বাবুলের খুব ইচ্ছে করে প্রতিমা যেন আজ সারাদিন বাড়িতে থাকে। আজ সে নদীতে যাবে। সারা নদী তন্ন তন্ন করে খুঁজে সে একটি বড় মাছ ধরবে। বিক্রি করবে না। কত দিন একটি বড় মাছ ধরেও তারা নিজেরা খেতে পারেনি। বাজারে নদীর মাছের অনেক চাহিদা, বেশি দামে বিক্রি করা যায়। এইরকম একটি মাছের দামে তাদের সংসার চলে অনেকদিন। নদীতেও আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। বর্ষায় যখন নদীর পানি উপচে বন্যা হয়, বাবুল তখন রাত-দিন মাছের নেশায় নৌকায় কাটায়। শীতকালে শুকনো নদীতে সে কর্মহীন।


বাবুলের মন ভরিয়ে দিয়ে প্রতিমা বলে, ‘আইজ আর কামে যাইতাম নায়।’ বাবুল কৃতজ্ঞতা প্রকশ করে কচ্ছপটির কাছে। আজ ভোরে আবির্ভুত কচ্ছপটিকে ঈশ্বরের অপার দান বলে মনে হয় বাবুলের কাছে। কচ্ছপটি তাদের কয়েকদিনের স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখার সাহস এনে দিয়েছে। সাহস দিয়েছে একটি বড় মাছ ধরে বিক্রি না করার। এই তীব্র ঠান্ডায় যেন এনে দিয়েছে আগামী দিনের ওম। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে বাবুল। আগে ছেঁড়া জাল ঠিক করতে হবে। জালের সন্ধানে বাবুল ঘরে প্রবেশ করে। ঘর থেকে সে চিৎকার করে প্রতিমাকে জানিয়ে দেয়, ‘আইজ গাঙ্গে যাইমু।’ প্রতিমা বলে, ‘কাউট্টা আইজ থাকউক, সুনীলে খেলবনে।’


ঘরের কোণে রাখা জাল হাতে নিয়ে কাঁধে ঝুলায় বাবুল। উঠানে নেমে একবার আকাশের দিকে তাকালো। এটা তার অনেকদিনের অভ্যাস। কাঁধে জাল নিলেই যেন আকাশ তাকে ডাকে, জল নয়। প্রতিমা ও সুনীল বেশ ভালোই মজা পেয়েছে। তাদের পাশ দিয়ে উঠান পেরিয়ে রাস্তায় নামে বাবুল। শুনতে পেল প্রতিমা বলছে, ‘তাড়াতাড়ি আইও।’ হ্যাঁ, আজ সে তাড়াতাড়ি ফিরবে। একটা বড় রূপালি মাছ নিয়ে সে ফিরবে। নদী তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আজও নিশ্চয়ই তাকে ফিরিয়ে দেবে না। রাস্তার দু’ধারে খাল। বাবুল আপনমনে ছুটে চলে নদীর পানে। নদীটির নাম কাঞ্চনগাং। দু’তীরে অনেক কলমিলতা। ভরা বর্ষায় যে নদী উপচেপড়া যৌবনপ্রাপ্ত হয়, শীতে তাকে জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের মত দেখায়। তবু বহমান এ নদী যৌবনের বারতা প্রকাশ করে প্রতিনিয়ত। বাবুল জাল প্রস্তুত করে। দু’হাত কপালে ঠেকায়। মনে মনে জপ করে কুলদেবতার নাম। বৃত্তাকার ভাবে জাল উড়িয়ে দেয় নদীর বুকে। কুলদেবতা বোধহয় সন্তুষ্ট নয়, তাই প্রথম খেপ কোনো ফল বয়ে আনল না। বাবুল স্থান পরিবর্তন করল। খেপের পর খেপ দিয়ে যায়। নদী কি তবে মাছ শূন্য? তবু বাবুল হতাশ হয় না। সে জানে, একবার না একবার তার জালে টান পড়বেই।


কখন দুপুর হয়ে গেল বাবুল টেরই পেল না। দুপুরের ক্লান্তি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। একটু বিশ্রামের প্রয়োজনবোধ করে সে। নদীপারের প্রাচীন বটগাছটার নিচে সে হেলান দিয়ে বসল। একটি ফড়িং কলমিলতায় বসতে গিয়েও বসে না। ফিরে এসে বাবুলের জালে বসার চেষ্টা করছে। বড়, হলুদ রঙের ফড়িং। সুনীল এই রকম ফড়িং দেখলেই তার পেছনে দৌড়ায়। বাবুল ফড়িংটির দিকে হাত বাড়ায়। সব সময় যা হয় তা-ই হলো, উড়াল দিলো নদীর উপর দিয়ে। উড়ন্ত ফড়িংটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বাবুল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো।

৩.

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তা আন্দাজ করতে পারছিল না বাবুল। তবে সে সূর্যটাকে লাল হয়ে পশ্চিমাকাশে ডুবে যেতে দেখল। সাথে সাথেই প্রতীক্ষারত প্রতিমা ও সুনীলের কথা মনে পড়ল। মুখের চোয়াল ও হাতের পেশী শক্ত হয়ে যায় বাবুলের। আবারো জাল হাতে নেয়। সামনের যে জায়গায় নদী বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছে সে। জালকে হাতের কনুই পর্যন্ত জড়িয়ে নেয় ভালোভাবে। বাম পাকে সামনে রেখে ডান পাকে পেছনে নেয়। শরীরটা একবার ডান থেকে বামে, আবার বাম থেকে ডানে মোচড় দেয় কয়েকবার। চোখ বন্ধ করে স্থির হয়। তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে জাল ছুঁড়ে দেয়। শূন্যে গোলাকার হয়ে জাল ডুবে যায় শুকিয়ে যাওয়া নদীর অগভীর জলে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। হঠাৎ দড়িতে রোমাঞ্চকর সেই টান টের পায় বাবুল। তার অভিজ্ঞতায় সে জানে, দড়ি দিয়ে জাল টেনে উপরে তুললে মাছটি হারাতে হতে পারে। লুঙ্গি কাছুটি দিয়ে লাফ দেয় নদীর জলে। ডুব দিয়ে নদীর মাটি স্পর্শ করে। জালের উপর দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে যায় সে মাছটির খোঁজ। জাল দিয়ে দু’প্যাচ দিয়ে মাছটিকে কাবু করে বাবুল। বড় একটা কাতলা মাছ।

বিকেল যখন সন্ধ্যার কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে; তখন বাবুল বাড়ি ফিরল। মাছটা বারান্দায় রেখে জাল মেলে দিলো উঠানে। শীতে কাঁপছে বাবুল। দু’হাত বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গিতে রেখে, একটু কুঁজো হয়ে সে ডাক দিলো, ‘ও পতি... প্রতিমা, মাছ লইয়া আইছি।’ ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসে প্রতিমা। নীরব চেয়ে থাকে বাবুলের দিকে। বাবুল বলে, ‘বেশি দেরী অই গেছে পতিমা।’ প্রতিমা কিছু বলে না। বটি হাতে নিয়ে সে মাছ কুটতে শুরু করল। বাবুল ভেজা লুঙ্গি ছেড়ে গামছা পরে নিল। ঘর থেকে বাবার জামা হাতে বের হয়ে এলো সুনীল। বাবুল সুনীলকে কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে। প্রতিমার শরীরটা আজ ভালো নেই। জ্বর ও মাথাব্যথা নিয়ে প্রতিমা শুয়ে ছিল সারা দুপুর, বিকেল। এইরকম জ্বর প্রতিমার এখন প্রায় প্রতিদিন হয়।


৪.

অন্ধকার নেমে এসেছে শীতের তীব্রতা নিয়ে। প্রতিমা মাটির চুলায় আগুন জ্বালিয়েছে। তাতে গরম ভাতের বলক উঠছে। মাছ কেটে রাখা হয়েছে আলাদা করে। রান্নার সব উপকরণ আজই শেষ হবে। বারান্দার একপাশে রাখা কচ্ছপকে ঢেকে রাখা টুকরির দিকে তাকায় প্রতিমা। একটু সাহস পায় সে। হাঁটু ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে জড়োসড়ো হয়ে বসে। একটি মলীন লাল চাদর গায়ে দিয়ে প্রতিমার পাশে বসে বাবুল। সে বারান্দার ভাঙা খুঁটিতে হেলান দেয়। কোলে তন্দ্রাচ্ছন্ন সুনীল। তাকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব বাবুলের। না খেয়ে যেন ঘুমিয়ে না পড়ে, এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে প্রতিমা। বাবুল দায়িত্বটা খুব ভালোভাবে পালন করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। তার মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। প্রতিমার এখন প্রতিদিন জ্বর আসে। শহরে গিয়ে একজন ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। না, কাল সকালে কচ্ছপটাকে মজুমদার বাড়িতে বিক্রি করে দিয়ে প্রতিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে।

এ গ্রামে রাত হয়ে যায় দ্রুত। সন্ধ্যার পর কিছুক্ষণ চলে রান্না ও খাওয়ার আয়োজন। তারপরই প্রতি ঘরের প্রদীপ ধীরে ধীরে মৃদু হয়ে আসে। কারো পুরোটা নিভে যায়। তারপর গ্রামের বুকে নেমে আসে ঘুমের নীরবতা। সুনীলকে খাওয়ানো হয়েছে আধো ঘুম ও আধো জাগরিত অবস্থায়। দরজায় খিল দিয়ে বাবুল হারিকেনের আলোটা মৃদু করে রাখে। প্রতিমা জানে এ আলো বেশিক্ষণ থাকবে না। এরপরই ঘরজুড়ে নামবে অন্ধকার। অন্ধকারকে বড় ভয় পায় সে। বাড়ির পেছনের বাঁশ বাগান থেকে শোনা যাচ্ছে ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক। টিনের চালে টুপটুপ শিশিরের শব্দ। ভাঙা টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে তাদের বিছানা ভিজে যায় শিশিরের জলে। মাঝে সুনীলকে রেখে প্রতিমা ও বাবুল জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হিমেল বাতাস শরীরের মাংস কেটে নিয়ে যেতে চায়। অন্ধকারে যেন শীতের তীব্রতা বেশি করে টের পায় প্রতিমা। তার জ্বর আরও বেড়েছে। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। সকালে উঠেই কাজে যাওয়ার কথা মনে হতেই তার কষ্ট, যন্ত্রণা আরও বেড়ে গেল। কত ভালো হতো! যদি কালও সারাদিন বাড়িতে থাকা যেত। এসব ভাবনার মধ্যেও এক সুখের অনুভূতি ছড়িয়ে গেল তার মনজুড়ে। মজুমদার বাড়িতে কচ্ছপটা বিক্রি করলে একটু বেশি টাকা তারা চেয়ে নিতে পারবে। অনেকদিন আগে বাড়ির কর্তা একটি কচ্ছপের কথা বলে রেখেছিলেন। কারণ এখন আর আগের মত কচ্ছপ পাওয়া যায় না। তাই একটু বেশি দামেই তারা এটা বিক্রি করতে পারবে। এরপর বাবুল বাজারে যাবে। একটি বড় কম্বল কিনতে হবে, আগামী রাতগুলো তারা একটু গরম ওমে ঘুমাবে। বাবুল ও সুনীলের জন্য গরম কাপড় কিনতে হবে। আর কয়েকদিনের জন্য একটু খরচাপাতি। যাতে কয়েকদিন তাকে কাজে যেতে না হয়। বেলা করে সে ঘুম থেকে উঠবে। যখন সকালের রোদ বারান্দা ছুঁয়ে যাবে; তখন মাটির পেয়ালায় তারা গরম চা খাবে। গরম ভাপা পিঠা তুলে দিবে সুনীলের হাতে।


প্রতিমার মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। গরম নিশ্বাসের স্পর্শ পাচ্ছে সে। ক্লান্তি নেমে আসছে সারা শরীরে। তার গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে বুঝতে পারছে, তার জ্বর ক্রমেই বাড়ছে। প্রচণ্ড শীতে কাহিল হয়ে বাবুলের কিছু তন্দ্রার মত আসছিল। প্রতিমার গোঙানি শুনে তার তন্দ্রা ভঙ্গ হয়। প্রতিমার কপালে হাত রেখে সে চমকে ওঠে। জ্বরে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। থর থর করে কাঁপছে প্রতিমা। কী করা উচিত ভেবে পায় না বাবুল। ঘর অন্ধকার। হারিকেন পুরো নিভে গেছে। জ্বালানোর চেষ্টাও বৃথা। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে বাবুল বিছানা থেকে নামে। চৌকির নিচ থেকে কয়েকটি চটের বস্তা বের করে সে। প্রতিমার গায়ের কাঁথার উপর চটের বস্তা জড়িয়ে দেয়। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রতিমাকে বুক দিয়ে চেপে ধরে বাবুল। প্রতিমার কাঁপুনিতে বাবুলও কেঁপে ওঠে। সে আরও শক্ত করে চেপে ধরে প্রতিমাকে। প্রতিমার গোঙানি বাড়ছে। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে কুকুরের রাতের আর্তনাদ। বাবুলের ভয় হয়। কেমন যেন একটা অমঙ্গলের বারতা পায় সে। বাবুল অপেক্ষার প্রহর গোনে ভোরের আলোর জন্য।


৫.

কচ্ছপটিকে ঢেকে রাখা টুকরির চারপাশে পাগলের মত ঘুরছে কুকুরটি। নখ দিয়ে আঁচড় দেয় কয়েকবার। একসময় চাপা দিয়ে রাখা ইটটি পড়ে যায়। টুকরিটি উল্টে গিয়ে উঠানে ঘুরে ঘুরে স্থির হয়। অবমুক্ত কচ্ছপটিকে দেখে কিছুটা দূরে চলে যায় কুকুরটি। কুকুরের ভয় জাগানো আর্তনাদ আরও বাড়ে। কচ্ছপটি মুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে উঠানে নামে। উঠান থেকে রাস্তায়। তারপর খেজুর গাছের নিচ দিয়ে চলে যায় পুকুর পারে। যেন পেয়ে যায় তার গন্তব্য। তখন ভোর হতে আরও অনেক বাকি। কুকুরটি আরও কয়েকবার আর্তনাদের সুর দিয়ে চুপচাপ হয়ে যায়। হঠাৎ এক নীরবতায় নিস্তব্ধ হয় বাবুলের পুরো বাড়ি।

  • সর্বশেষ - সাহিত্য