টাকার লোভে চীনা নাগরিককে হত্যা
প্রকাশ :
রাজধানীর বনানীতে চীনা নাগরিক গাউজিয়ান হুই (৪৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুই নিরাপত্তাকর্মীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারা হল আবদুর রউফ (২৬) ও ইনামুল হক (২৭)। নগদ টাকার লোভে গলায় গামছা পেঁচিয়ে গাউজিয়ানকে হত্যা করে তারা। বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং আদালতে বিষয়টি স্বীকার করেছেন রউফ এবং ইনামুল। এদিন তাদের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। মঙ্গলবার রাজধানীর বনানী এলাকায় অভিযান চালিয়ে দু’জনকে গ্রেফতার করে ডিবি। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ১৯ হাজার নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়।
বুধবার দুপুরে রউফ এবং ইনামুলকে আদালতে হাজির করে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুল হক। রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানির সময় আসামিরা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে। তারা বলে, গামছা পেঁচিয়ে আমরা তাকে হত্যা করি। আমরা তাকে হত্যা করে ভুল করেছি। শুনানি চলাকালে আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না। ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন আসামিদের কাছে জানাতে চান, তাদের কিছু বলার আছে কিনা। এ সময় তারা চুপ থাকে। পরে বিচারক প্রশ্ন করেন, কত টাকা নিয়ে গেছেন? এর উত্তরে তারা বলে, ‘তিন লাখ ৪৯ হাজার টাকা তার কাছ থেকে নিয়ে যাই।’ শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে বুধবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে হত্যার বর্ণনা দেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, বনানীর ২৩ নম্বর সড়কের ৮২ নম্বর বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিল আবদুর রউফ ও ইনামুল হক। তারা ওই ভবনের ছাদে বসবাস করত। একত্রে চাকরির সুবাদে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওই ভবনে বসবাসকারী বিত্তবান লোকদের জীবনযাত্রা ও নিজেদের দৈন্যদশা দেখে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়। নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় বারবার কীভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় তা নিয়ে কথা বলে। হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে রউফ প্রস্তাব দেয় যে, চীনা নাগরিক গাউজিয়ান অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে আসা-যাওয়া করে, ফ্ল্যাটে একা থাকে। তাকে হত্যা করে টাকা নিতে পারলে জীবনে আর কিছু করা লাগবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। তারা নিশ্চিত হয় যে, ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরাতে ভিডিও রেকর্ড কাজ করে না। কারণ হার্ডডিস্ক নেই। ৬ ডিসেম্বর একবার তারা গাউজিয়ানকে হত্যার চেষ্টা করে। ওইদিন সন্ধ্যায় তারা গাউয়ের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে (৬-ই ও ৫-ই) কলিংবেল দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা না খোলায় ভয়ে তারা আবার ফিরে আসে। এরপর ১০ ডিসেম্বর তারা পুনরায় পরিকল্পনা করে যে আজকে কাজ শেষ করতেই হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইনামুল তার নিজের ব্যবহৃত গামছা সঙ্গে নিয়ে যায়। মাগরিবের আজানের পরপরই তারা গাউজিয়ানের ফ্ল্যাটের সামনে যায়। রউফ কলিংবেল চাপ দেয়। গাউ দরজা খুলে ওদের দিকে বিস্ময়ে তাকায়। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষাই জানতেন না। তবে ইশারায় জানতে চাচ্ছিলেন যে, কি বিষয়? তখন ইনামুল ওয়াটার ওয়াটার বলে বোঝাতে চায় যে, তারা পানি খাবে। মুহূর্তের মধ্যেই তারা দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। গাউয়ের গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরে ইনামুল। রউফ কোমরের দিকে জাপটে ধরে। অল্প সময়ের মধ্যেই গাউয়ের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে গাউয়ের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড়ে দেয় রউফ। ২-৩ মিনিটের মধ্যেই তারা গাউয়ের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বলেন, গাউকে যখন হত্যা করা হয় তখন ফ্ল্যাটের ভেতর ড্রয়িং রুমের টেবিলে তার ল্যাপটপ খোলাই ছিল। পাশে ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকা একটি ছোট ব্যাগ। রউফ ওই ব্যাগটি খুলে সেখানে থাকা ৩টি ১০০০ টাকার বান্ডিল, কিছু খুচরা টাকা ও মোবাইল নিজেদের হেফাজতে নেয়। এরপর গাউয়ের নিথর দেহ ড্রয়িংরুমে নিয়ে গামছা দিয়ে রক্ত মুছে দিয়ে বের হয়ে ছাদে চলে যায়। ছাদে গিয়ে গামছা ধুয়ে ও নিজেরা গোসল করে একসঙ্গে দু’জন বের হয়ে যায়। টাকাগুলো গণনা করে ভাগ করে নেয়। রউফ নেয় এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা। ইনামুলকে দেয় এক লাখ ৭৩ হাজার টাকা। তারা বনানী সুপার মার্কেটের পাশে একটি চায়ের স্টলে বসে চা খায় এবং টাকাগুলো কি করবে তা নিয়ে আলোচনা করে। রউফ সুপার মার্কেটের আশপাশে থাকা তিনটি বিকাশের দোকানের মাধ্যমে তার গ্রামের বাড়িতে বন্ধু হাসানের কাছে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা টাকা পাঠিয়ে দেয়। ইনামুল চারটি বিকাশের দোকান থেকে তার নিজের বিকাশে ৫০ হাজার টাকা, এলাকার বড় ভাই করিমের (মিরপুরে বাসাবাড়ির ম্যানেজার) কাছে ৫০ হাজার টাকা, বন্ধু শাহীনের কাছে ৪০ হাজার টাকা এবং তার মেজ ভাবির কাছে ৩০ হাজার টাকাসহ মোট এক লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয়।
বাতেন আরও বলেন, ওইদিন রাত ১১টার দিকে রউফ বিল্ডিংয়ের পেছনের দিকে বালুমাটিতে কাঠের টুকরো দিয়ে গর্ত করে। পরে লিফট ব্যবহার করে ভিকটিমের লাশ নিচে নামিয়ে সেখানে মাটিচাপা দেয়া হয়। পরদিন ১১ ডিসেম্বর গাউয়ের ড্রাইভার ও কাজের বুয়া বাসায় এসে তাকে পায়নি। তার ব্যবহৃত সেন্ডেলে রক্তের দাগ দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। একপর্যায়ে গাউয়ের ড্রাইভার সুলতান ভবনের পেছনে মাটিচাপা অবস্থায় গাউয়ের পায়ের গোড়ালি দেখে পুলিশকে খবর দেয়। মাটিচাপা অবস্থায় গাওয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গাউজিয়ান হুই মূলত ব্যবসায়ী। পায়রা বন্দর ও পদ্মা সেতু নির্মাণে পাথর সরবরাহের কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি। এসব ব্যবসায় কয়েকজন বাংলাদেশি ও চীনা অংশীদার ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম, উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান, ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের ডিসি মাসুদুর রহমান, গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী এবং এডিসি (এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুল আহাদসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।