, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর পরিবেশ প্রেম

  ফিচার

  প্রকাশ : 

বঙ্গবন্ধুর পরিবেশ প্রেম

সফিউল আযম

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন প্রকৃতি প্রেমিক। একজন পরিবেশ প্রেমিক। দেশমাতৃকার প্রতি যে দরদ ও ভালোবাসা বঙ্গবন্ধু সব সময় অনুভব করতেন, ঠিক তেমনি দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিও ছিল অন্যরকম ভালোবাসা। কারাগারের মধ্যে থেকেও পরিবেশের প্রতি একটুও টান কমেনি। কারাগারের রোজনামচা বইয়ে দেখা যায়, ১৭ জুলাই ১৯৬৬ সালের ঘটনায় বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘বাদলা ঘাসগুলি আমার দুর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিতেছে। কত যে তুলে ফেললাম। তুলেও শেষ করতে পারছি না। আমিও নাছোড়বান্দা। আজ আবার কয়েকজন কয়েদি নিয়ে বাদলা ঘাস ধ্বংসের অভিযান শুরু করলাম। অনেক তুললাম আজ।...আমি কিছু সময় আরও কাজ করলাম ফুলের বাগানে।’ একজন প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব সময় সুজলা সুফলা স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে আত্মনিয়োগ করতেন।

‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি শুরু করা হয় জাতির জনকের এ উদ্ধৃতি দিয়েই। এখানেই নিহীত আছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণতা। মানুষের কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুকেই সমানভাবে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন। প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিও ছিল অন্যরকম ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী প্রজ্ঞায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের বিষয়কে অধিক গুরুত্বারোপে আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’

সদ্য একটি স্বাধীন দেশে বৃক্ষসম্পদের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে, সে ক্ষতি পূরণের জন্য ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঘোরদৌড় বন্ধ করেন বঙ্গবন্ধু। এই ময়দানে গাছ লাগিয়ে নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গণভবন ও বঙ্গভবনে গাছ লাগিয়ে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, দেশজুড়ে শুরু করেন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বাড়ির আশেপাশে, পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণে সবাইকে আহ্বান জানান তিনি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যেভাবে সবাই দেশমাতৃকাকে রক্ষার শপথ দেন, ঠিক তেমনি পরিবেশ রক্ষা ও বৃক্ষরোপণে জাতির জনকের আহ্বানে সবাই সাড়া দেন। দেশের জনগণ বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ উপ-কমিটি কর্তৃক সবুজ পরিবেশ আন্দোলন দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছে। আওয়ামী লীগ কর্তৃক ইতোমধ্যে ১ কোটি ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।

আজ সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শোনা যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা, দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির বিকল্প নেই, বিষয়টি বঙ্গবন্ধু আগেই অনুধাবন করেন। উপকূলীয় এলাকাকে সবুজায়ন করার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু। একজন পরিবেশ প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সব সময় পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য দিতেন। উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপণের বিষয়টি অনুধাবন করেন এবং জনসচেতনতা আনয়ন করেন। আজকের বাংলাদেশের রাস্তার দুপাশে যে সারি সারি বৃক্ষরাজি আমাদের প্রকৃতিকে অপরূপ করেছে, দৃষ্টিনন্দন করেছে, এর সূচনা হয়েছিল জাতির জনকের হাত ধরেই। আর তাই তো দুর্যোগ মোকাবিলায় সারাবিশ্বে বাংলাদেশ রোলমডেল হিসেবে পরিচিত। পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত হন।

১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ কর্মসূচি উদ্বোধনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য, বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়া যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এটা হলো বেরিয়ার, এটা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে একদিন খুলনা, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ পর্যন্ত এরিয়া সমুদ্রে তলিয়া যাবে এবং হাতিয়া ও সন্দ্বীপের মত আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার সুন্দরবন যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোন উপায় আর নাই।’ আসলেই, আজকের বাংলাদেশে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই সুন্দরবন আমাদের রক্ষায় কাজ করে। জাতির জনক মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন এ সুন্দরবন ও উপকূল রক্ষার বিষয়টি।

পরিবেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়াটার পলিউশন কন্ট্রোল অর্ডিনেন্স ১৯৭৩ জারি করেন। ১৯৭৩ সালেই পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমের সূচনা হয়। পরবর্তীতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমান পরিবেশবান্ধব সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছে। নির্বাচনী ইশতেহারে সরকার বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কার্যকরী ভূমিকা রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে, কিন্তু জাতির জনক তার দূরদর্শী চিন্তায় অনেক আগেই বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪ প্রণয়ন করেন। যার মাধ্যমেই বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় বাংলাদেশে। আইনটিতে বাংলাদেশে বসবাস ছিল বা আছে এমন সব বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা যায়, বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার একটি বলিষ্ঠ অধ্যায় বঙ্গবন্ধু প্রণীত এই আইন।

উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করে ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম, যা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই। দেশের উদ্ভিদ প্রজাতির উপর মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য-উপাত্তসহ শুষ্ক উদ্ভিদ নমুনা সংরক্ষণ ও শ্রেণিবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান এ হার্বেরিয়াম। উদ্ভিদ প্রজাতির সংরক্ষণ এবং বংশ পরম্পরায় যাতে এটির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে, তাই দেশের নানা প্রান্তের উদ্ভিদ এখানে সংরক্ষণ করা হয়। যা পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

মহাসড়কের দু’পাশে, উপকূলীয় এলাকায় বৃক্ষরোপণের সূচনাও হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। দেশের হাওর, নদ-নদী ও জলাভূমি রক্ষার প্রতিও জোর দেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এসব উন্নয়নে রূপরেখা প্রণয়ন করেন। বনশিল্পকে রক্ষায় আধুনিকায়ন করেন বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন। যা রাবার ও কাঠ শিল্পকে টেকসই করাসহ পাহাড়ি ও গ্রামীণ জনপদে কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেন, ‘আমি একটা ফুলের বাগান শুরু করেছিলাম। এখানে কোনো ফুলের বাগান ছিল না। জমাদার সিপাহীদের আমি ওয়ার্ড থেকে ফুলের গাছ আনতাম। আমার বাগানটা খুব সুন্দর হয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা ১৭১) জাতির জনকের এ প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাদের জন্য অনুকরণীয়। দেশের প্রকৃতি-পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বঙ্গবন্ধু যে সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলন সূচনা করেছিলেন, তা অব্যাহত রেখেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আজ সবুজায়নের চাদরে আচ্ছাদিত। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় জাতির জনকের পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার। সারাদেশে নানা প্রজাতির বৃক্ষে শোভিত নির্মল পরিবেশ। পরিবেশপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ অনন্য উচ্চতায়। মুজিব শতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধা হে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: সমাজসেবা সম্পাদক, সবুজ পরিবেশ আন্দোলন।

  • সর্বশেষ - ফিচার