, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

মুরগির খামারিদের টিকিয়ে রাখতে দরকার মার্কেট চেইন পুনর্নির্মাণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

মুরগির খামারিদের টিকিয়ে রাখতে দরকার মার্কেট চেইন পুনর্নির্মাণ

দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পোল্ট্রি সেক্টর একটা বড় ভূমিকা পালন করে। ভবিষ্যতে যেন পুষ্টির অভাব না হয় সে জন্য এখনই পোল্ট্রি সেক্টরে নজর দেয়া উচিত সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের। সরকার এসব সেক্টরে যে প্রণোদনা দিতে চেয়েছে সেটাও দেরি না করে খুব দ্রুত প্রকৃত খামারিদের মাঝে বিতরণ করা দরকার। গ্রামপর্যায়ে যেসব এনজিও কাজ করে তারাও প্রান্তিক খামারিদের ঋণ দিয়ে এই সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এছাড়া খামারিদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে যে চেইন (শৃঙ্খলা) ভেঙে গেছে তা ঠিক করতে হবে। খামারি-ব্যাপারী-আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে যে সম্পর্ক এটা বজায় থাকলে খামারিদের কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। খামারিরা আবার পূর্বের ন্যায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন। এমন মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও খামারিরা।


বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এক মাস আগে ৩৫ টাকার মুরগির বাচ্চার দাম ছিল এক টাকা। তাও কেউ খামারে তুলছিল না। ফ্রি মুরগির বাচ্চা দিতে চাইলেও কোনো খামারি নতুন করে মুরগির বাচ্চা নেয়নি। লাখ লাখ বাচ্চা প্রতিদিন মেরে ফেলতে হয়েছে খামারিদের। কারণ করোনার শুরুতে গোটা দেশ যখন অচল হয়ে যায় তখন মুরগি, বাচ্চা ও ডিম কোনোকিছুই বেচাকেনা হয়নি। লোকসান খেয়ে হাজার হাজার খামারি পথে বসে গেছে। এখন প্রান্তিক খামারিরা আর খামারে মুরগি তুলছেন না। হাজার হাজার খামার এখন খালি পড়ে আছে। অনেকে মূলধন হারিয়ে ঘরে বসে আছেন বেকার অবস্থায়। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে পুষ্টির অভাব দেখা দেবে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে কী করতে হবে তা নিয়ে কথা হয় দুজন বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও কয়েকজন খামারির সঙ্গে। তারা যে মতামত দিয়েছেন তা বাস্তায়ন করতে পারলে এ সেক্টরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।


এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি  বলেন, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা (সাপ্লাই চেইন) ভেঙে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এটা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। খামারিরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারবে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ জন্য খামারি-ব্যাপারী-আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে যে সম্পর্ক ভেঙে গেছে তা আবার ফিরে আনতে হবে। এই ব্যাপারী বা পাইকার যাতে তাদের ব্যবসার পণ্য নিয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে। রাস্তায় কোনো ঝুট-ঝামেলার শিকার না হয় এ ব্যবস্থাগুলো নেয়া খবই জরুরি।


তিনি বলেন, করোনার কারণে অনেক খামারি পুঁজি হারিয়েছেন। সরকার তাদের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তা এখনই তাদের হাতে পৌঁছানো দরকার। টাকাটা হাতে পেলেই তারা এখনই আবার উৎপাদন শুরু করতে পারবে। এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে পারলে কৃষকের মুরগির খামার আবার ভরে উঠবে। তখন পুষ্টি নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের আক্রমণের কারণে সারাদেশে লকডাউন অবস্থা শুরু হয়। পুরো দেশ স্থবির হয়ে পড়ে। এসব কারণেই খামারিরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আর কিছুদিন সময় লাগবে। কৃষক আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।


এ বিষয়ে কথা হয় এমেরিটাস অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সাবেক উপাচার্য, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) এবং বিশেষজ্ঞ পুল, বার্ষিক কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদস্য ড. এম এ সাত্তার মন্ডলের সঙ্গে।


তিনি  বলেন, করোনার ভয়ে বসে থাকলে চলবে না, এখনই কাজে নামতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্ষেত খামারে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। সরকার খামারিদের যে প্রণোদনা দিতে চেয়েছে তা এখনই দিয়ে দেয়া দরকার। কৃষক যেন টাকার অভাবে তার খামারে উৎপাদন বন্ধ না রাখে। দেশে যে অবস্থা চলছে তাতে কৃষকের পণ্য বাজারজাতকরণের বিষয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।


তিনি বলেন, করোনার কারণে যে মার্কেট চেইন ভেঙে গেছে তা ঠিক করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু উৎপাদনকারী নয়, যারা পাইকার খামার থেকে পণ্য নিয়ে বিক্রি করে তাদের প্রণোদনার আওতায় আনা দরকার। করোনার কারণে অনেক পাইকার অর্থাভাবে আছে। তাদের সহযোগিতা করলে তারাই চেইন ঠিক রাখবে।


গাজীপুর জেলার কুদাবো এলাকার তুষার পোল্ট্রি খামারের মালিক সেলিনা পারভিন জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে জানান, এবারের ব্যবসায় তিনি লেয়ার এবং ব্রয়লার মিলে দুই সেকশনে প্রায় ১০ লাখ টাকা লোকসান খেয়েছেন। এখন তার খামার খালি পড়ে আছে। ব্রয়লার এবং লোয়ার কোনো শেডেই মুরগি নেই।


আবার ব্যবসা শুরু করবেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুনলাম করোনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকার নাকি আমাদের ঋণ দেবে। এই ঋণ সরকার যত দ্রুত দিতে পারবে আমরা কৃষকরা তত দ্রুত খামারে মুরগি পালন শুরু করতে পারব। এছাড়া স্থানীয় অনেক এনজিওর সদস্য আমরা। তারা যদি ঋণের পরিমাণটা বাড়ায় তাহলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।


যশোরের সবচেয়ে বেশি বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আফিল এগ্রো লিমিটেডের পরিচালক মাহবুব আলম লাবলু জাগো নিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রান্তিক অনেক কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কম দামে ব্রয়লার মুরগি ও ডিম বিক্রি করে অনেক খামারি পুঁজি হারিয়েছেন। একটা সময় আমরা এক টাকা পিস মুরগির বাচ্চা দিতে চেয়েছি খামারিদের তাও তারা নেয়নি। কারণ মুরগির খাবারসহ বিভিন্ন খরচ করে সে খরচ উঠবে কিনা এই আশঙ্কা থেকে তারা খামার খালি রেখেছে।


তিনি বলেন, খামারিদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকার এই সেক্টরের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সেই প্রণোদনার টাকা নগদ দ্রুত কৃষকের হাতে দিলে তারা আবার ব্যবসা শুরু করতে পারবে। এছাড়া যারা পাইকার তারা তাদের পণ্য নিয়ে যেন সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করতে পারে। রাস্তায় যেন কোনো হয়রানির শিকার না হয় সেদিকটা সরকার খেয়াল রাখলে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছে যাবে। তখন আর কোনো অসুবিধা হবে না।


সরকারের প্রণোদনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রী বলেছে, এটা শুনেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো কার্যক্রম নজরে পড়েনি।


টাঙ্গাইলের পোল্ট্রি খামারি ফরহাদ হোসেন  বলেন, সরকারি প্রণোদনা না পেলে অনেকেই ব্যবসা পুনরায় শুরু করতে পারবে না। কারণ করোনায় প্রান্তিক অনেক খামারির পুঁজি হারিয়ে গেছে। যারা বড় ব্যবসায়ী তারা কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েও হয়তো টিকে থাকতে পারবেন। কিন্তু প্রান্তিক চাষিরা যারা দুই থেকে পাঁচ হাজার মুরগি পালন করে তারা টিকে থাকতে পারবে না।


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মুরগি বা ডিম কিনে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করার ব্যবস্থা করলে খামারিরা উপকার পাবে। এছাড়া এসব পণ্য চলাচলে পুলিশের ভোগান্তির শিকার না হলে ব্যাপারীরাও উৎসাহিত হবে।


সরকারের প্রণোদনা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনও খামারিদের কাছে এ বিষয়ে কোনো খবর আসেনি। প্রাণিসম্পদ অফিস থেকেও কেউ যোগাযোগ করেনি।


মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রজনন) একেএম আরিফুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি খামারিদের তালিকা করা হচ্ছে। আমাদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে, আমরা তালিকা তৈরি করছি। প্রণোদনা কে কীভাবে পাবে সে বিষয়ে আমাদের কাছে এখনও স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা আসেনি। তালিকা তৈরি হয়ে গেলে সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

  • সর্বশেষ - অর্থ-বাণিজ্য