, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

যে কারণে ঋণের সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা যায়নি

  অনলাইন ডেস্ক

  প্রকাশ : 

যে কারণে ঋণের সুবিধাভোগী চিহ্নিত করা যায়নি

পরিদর্শন নীতিমালায় পরিবর্তন আনায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) দেওয়া ঋণের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা, তা চিহ্নিত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কেবল প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা কাদের নামে নেওয়া হয়েছে, সেটি তুলে ধরা হলেও প্রকৃত সুবিধাভোগীদের বের করা যায়নি।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগের তৈরি এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হয়েছে। তবে আদালতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ওই ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা সরিয়েছেন প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার। 

সূত্র জানায়, গত বছরের ১৯ আগস্ট থেকে পাঁচ দিনব্যাপী ইন্টারন্যাশনাল লিজিং পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া নথিপত্র পর্যালোচনা করেই এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি চাহিদামতো নথি সরবরাহ করেনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিদর্শন নীতিমালায় অনুমোদন না থাকায় সন্দেহজনক লেনদেন পরিলক্ষিত হলেও অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিবরণী যাচাই বা সর্বশেষ সুবিধাভোগী পরীক্ষা করা যায়নি। ফলে ঋণের সর্বশেষ ব্যবহার ও লাভবান ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুষ্ঠু পরিদর্শনের স্বার্থে অনুমোদন নিয়ে প্রকল্প পরিদর্শনের সুযোগ আছে। তবে এ ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছে, তা আমি জানি না।’

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়। এর ফলে ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে কি না, তা পরিদর্শন করতে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত অবহিত করার নিয়ম করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন নীতিমালায় বিষয়টি সংযোজন করেন ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান, তিনি তদারকি কমিটিরও প্রধান।

সূত্র জানায়, এক ‘অনুমোদন’ না থাকার কারণেই আটকে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরো পরিদর্শন কার্যক্রম। এতে প্রকৃত তথ্যই বের হচ্ছে না, ব্যবস্থা গ্রহণ তো অনেক পরের ব্যাপার।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি তুলনামূলক দুর্বল প্রতিষ্ঠানে ৫১৪ কোটি টাকা জমা রেখেছে। এর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে রয়েছে ২২২ কোটি টাকা, যেটি ইতিমধ্যে অবসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া এফ এ এস ফাইন্যান্সে ৬০ কোটি টাকা, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ৮১ কোটি টাকা ও প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৪১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

উল্লেখ্য, পি কে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে থেকে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টাকা বের করেন। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অবসায়ন হচ্ছে, আর টাকা ফেরত দিতে পারছে না পি কে হালদারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফ এ এস ফাইন্যান্স ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। 

কাদের নামে ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা তুলে ধরা হলেও প্রকৃত সুবিধাভোগীদের বের করা যায়নি।

২০১৯ সাল শেষে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকায় ও ঋণ ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের ৭৫৯ কোটি টাকা আমানত ফেরত দিতে পারেনি। এর ফলে আদালতের নির্দেশে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। এক মাস না যেতেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। এরপর জানিয়েছেন, পি কে হালদারই ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। এটা উদ্ধারে দুদককে উদ্যোগ নিতে হবে। 

যাঁদের নামে যত ঋণ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি সমন্বিতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া তাঁরা একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’ 

যাঁদের নামে ঋণ বের হয়েছে, তাঁদের অনেকেই পি কে হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, আবার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদেও আছেন অনেকে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের দেওয়া ঋণের সুবিধাভোগীরা হলেন—পি কে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার, পূর্ণিমা রানী হালদার, সঞ্জীব কুমার হালদার, অমিতাভ অধিকারী, অভিজিত অধিকারী, সোমা ঘোষ, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, অরুণ কুমার কুন্ডু, রাজীব সোম, শিমু রায়, রতন কুমার সমাদ্দার, মৈত্রী রানী ব্যাপারী, সুস্মিতা সাহা, রতন কুমার বিশ্বাস, উদ্দাব মল্লিক, অতসী মৃধা, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, সুব্রত দাস, তোফাজ্জল হোসেন, অনিন্দিতা মৃধা, সুস্মিতা সাহা, কাজী মোমরেজ মাহমুদ, আবু রাজেব মাহমুদ, অনঙ্গ মোহন রায়, অনামিকা মল্লিক, রাম প্রসাদ রায়, গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলি, এস এম তাসিন হাসান, অমল কৃষ্ণ দাস, মশিউর রহমান, সাব্বির আহমেদ, শাহ আলম শেখ, সিদ্দিকুর রহমান, মাহফুজা রহমান বেবি, এহসান আলী শেখ, জাহাঙ্গীর আলম ও কাজী মাহজাবিন মুমতাজ। 

সুবিধাভোগীরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বের করে নেয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাল ইন্টারন্যাশনাল ১৩ কোটি, বর্ণা ৪৭ কোটি, ইমেক্সোকো ৬৫ কোটি, আরবি এন্টারপ্রাইজ ৬৩ কোটি, এসএ এন্টারপ্রাইজ ৭৩ কোটি, সন্দীপ করপোরেশন ৩০ কোটি, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল ৬০ কোটি, এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ৪৬ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্সের মালিকানায় থাকা পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল ৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া রেপটাইল ফার্ম ৬৩ কোটি, আনন কেমিক্যাল ৫০ কোটি, ড্রাই নুন অ্যাপারেল ৭৭ কোটি, সুখাদা প্রোপার্টিজ ৪৫ কোটি, নর্দার্ন জুট ৩৪ কোটি ও সিমটেক্স টেক্সটাইল ৮২ কোটি টাকা নিয়েছে।

  • সর্বশেষ - অর্থ-বাণিজ্য