, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ অনলাইন সংস্করণ

গণস্বাস্থ্যের কিট কি বাজারে আসবে?

  নিজস্ব প্রতিবেদক

  প্রকাশ : 

গণস্বাস্থ্যের কিট কি বাজারে আসবে?

মার্চ মাস। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত। পুরো দেশে আতঙ্ক। দিন যাচ্ছে আতঙ্কও বাড়ছে। প্রবাসীসহ অনেকেই করোনা পরীক্ষা করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। কিটের সঙ্কট। নেই পর্যাপ্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে করোনা শনাক্তে স্বল্পমূল্যে এবং দ্রুত টেস্টিং কিট উদ্ভাবনের কথা জানায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। দেশের মানুষের মধ্যে তীব্র আশার সঞ্চার হয়। মহামারি বিবেচনায় দ্রুত কিট বাজারে আনার অনুমোদনের আবেদন জানায় গণস্বাস্থ্য।

শুরু থেকেই দেখা যায় নাটকীয়তা। গণস্বাস্থ্যে কিটের নমুনা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে যাননি স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিংবা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরসহ সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। এরপর সিআরও (কন্ট্রাক্ট রিসার্চ ফার্ম) প্রতিষ্ঠান নিয়ে তৈরি হয় জটিলতা। ওষুধ প্রশাসন ও গণস্বাস্থ্যের সেই দ্বন্দ্বও  বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। একপর্যায়ে গণস্বাস্থ্যের দাবি মেনে ‘নামসর্বস্ব’ সিআরও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কিটের সক্ষমতা যাচাই পরীক্ষার পক্ষে মত দেয় ওষুধ প্রশাসন।

এক মাসের বেশি সময় কার্যকারিতা যাচাই শেষে বিএসএমএমইউয়ের ‘কার্যকারিতা যাচাই কমিটি’ জুনের শেষ দিকে জানায়, গণস্বাস্থ্যের কিট কার্যকর নয় । তবে গণস্বাস্থ্য জানায়, বিএসএমএমইউয়ের পরীক্ষায়ই তাদের কিট ৭০ শতাংশ সফল। এই মুহূর্তে এতটুকু সফল কিট বিশ্বের কোথাও নেই।

ওই সময় পর্যন্ত কিটের সক্ষমতা যাচাইয়ে ওষুধ প্রশাসনের কোনো নীতিমালা ছিল না। গণস্বাস্থ্যের কিটের ফল প্রকাশের পর ওষুধ প্রশাসন কিট যাচাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিমালা অনুসরণ করে, সেই নীতিমালা প্রণয়ন করে বাংলাদেশের জন্য। গণস্বাস্থ্য দ্বিতীয়বার তাদের কাছে গেলে ওষুধ প্রশাসন বলে, নতুন প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী কিটের সক্ষমতা যাচাই করে আনার জন্য। এ সময় গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘নতুন নীতিমালা অনুযায়ী কিটের সক্ষমতা যাচাই করার মতো পরীক্ষাগার বাংলাদেশে নেই। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ওষুধ প্রশাসনকে জানিয়েও কাজ হচ্ছে না।’

kit.jpg

এরই মধ্যে পেরিয়ে যায় প্রায় পাঁচ মাস। বর্তমানে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে গণস্বাস্থ্যের কিট আদৌ বাজারে আসার সম্ভাবনা আছে কি-না? জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবকিছু বিবেচনায় এটা বাজারে আসার সম্ভাবনা কম; নেই বললেও চলে। তবে আমরা আরেকটু ধৈর্য ধরতে চাই। সরকারের ইচ্ছা থাকলে দিয়ে দিত। এতে আমাদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। কিন্তু সরকারের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। জনগণ বঞ্চিত হয়েছে।’

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ভ্যাকসিন আসলে ভালো কথা। তবে কিট ও ভ্যাকসিন- দুটোর আলাদা ভূমিকা। কথা হলো, কিট তারা চায়না থেকে বা বাইরে থেকে আমদানি করছে। আমাদেরটা আটকে দিয়েছে। যাতে বাজারে না আসে। আমি তো বলেছি, ঘুষ না দিলে যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে। দেশবাসী বঞ্চিত হচ্ছে। আজ ৪০০ টাকা দিয়ে যেটা হতো, তারা সেটা তিন হাজার টাকা দিয়ে কিনছে, এই আর কি।’

গণস্বাস্থ্যের কিট বাজারে না আসার পেছনে ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তার মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপি-গণফোরামসহ কয়েকটি দল নিয়ে যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল, তাতে যুক্ত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। রাজনৈতিক পরিচয় ও অপরাজনীতির কারণেই গণস্বাস্থ্যের কিট বাজারে আসছে না বলে মনে করছেন বদিউল আলম। তিনি  বলেন, ‘এই কিটের ক্ষেত্রে আমরা যতটুকু ধারণা করতে পারছি দূর থেকে দেখে, এটা অপরাজনীতির শিকার।’

kit.jpg

তিনি বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা, কিটের অনুমোদন না পাওয়ার পেছনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রাজনৈতিক পরিচিতি, তার মতামত, সমালোচনা, সংস্কারক হিসেবে ভূমিকা— এসব কারণ থাকতে পারে। আমাদের আশঙ্কা, এটাই বড় ভূমিকা রেখেছে। এমনকি তাদের (গণস্বাস্থ্য) কিট যখন মূল্যায়ন করা হয়, তখন আমাদের বিশেষজ্ঞ ও যেসব প্রতিষ্ঠান কিটের মূল্যায়ন করেছে, তারা যেসব কথাবার্তা বলেছে, সেগুলো সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে। পুরোটা দলীয়করণ, দলীয় স্বার্থ, দলীয় বিবেচনা, ক্ষুদ্র স্বার্থ— এসব কারণে সবকিছু হচ্ছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভিন্নমত যারা পোষণ করে, ভিন্নমতে যারা সোচ্চার, তাদের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছেন তারা।’

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কোভিড-১৯ র‌্যাপিড ডট ব্লট কিট প্রকল্পের সমন্বয়ক ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘সরকারের ওষুধ প্রশাসন আমাদের যা যা করতে বলছে, আমরা তা-ই করছি। আজ বলছে, ডাল নিয়ে আসেন, ডাল দিচ্ছি। কাল বলছে, পেঁয়াজ নিয়ে আসেন, পেঁয়াজ দিচ্ছি। পরশু বলছে, হলুদ নিয়ে আসেন, হলুদ দিচ্ছি। এরকম আর কি। সরকার যা যা বলল, তাই তাই করলাম।’

‘সরকার এখন আমাদের যে কাজটা করতে বলছে, সেটা হলো, এভাবে টেস্ট করে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেই টেস্টটা বাংলাদেশে হয় না। সেটা করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কোথাও করার সুযোগ-সুবিধা নেই এবং বিরাট অঙ্কের টাকা-পয়সাও লাগে। বিষয়টি আমরা ওষুধ প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, প্রধানমন্ত্রীর অফিসকেও চিঠি দিয়ে জানিয়েছি যে, আমাদের এই কাজগুলো নতুন করে করতে বলছে; নতুন নিয়ম, কোনো ফ্যাসিলিটিস তো বাংলাদেশে নেই। আমরা এখন কী করব?’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত, এই টেস্ট করার সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশে নেই। দ্বিতীয়ত, এটা যদি বাংলাদেশে করতে চাই, তাতে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা লাগবে। সেই সঙ্গে সবকিছু অনুকূলে থাকলেও নতুন ল্যাব প্রস্তুত করে ৫ থেকে ৬ মাসের আগে যাচাই শেষ করা সম্ভব নয়। এখন এটা অনেকটা অসম্ভবই আর কি।’

jagonews24

মুহিব উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘মানসম্মতভাবে টিকা তৈরি করতে ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। যেহেতু এখন মহামারি, তাই সব দেশ ছয় মাস অথবা আরও কম সময়ের মধ্যে করার চেষ্টায়। সবাই মিলে জরুরি আইনের আওতায় অল্প সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন বাজারে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব টিকার (ভ্যাকসিন) সর্বোচ্চ সফলতা এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ বলল, আমরা যদি ৫০ শতাংশ পাই, তারপরও আমরা টিকা কিনব। এই টিকা কেনার জন্য তারা ইতোমধ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। তারা এটা মেনে নিয়েছে যে, টিকার সফলতা মাত্র ৫০ শতাংশ। আর আমাদের বাংলাদেশে হচ্ছে উল্টো। আমরা বিএসএমএমইউতে ৭০ শতাংশ সফলতা পেয়েছি। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে এটা সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর চেয়ে ভালো সেনসিটিভিটি কারও নেই। কিন্তু উনারা অন্য কারণে…। এটা দুঃখজনক আর কি।’

‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। কখন কী বলছে, না বলছে, তার ঠিক নাই। পুরো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়টা করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছে। সব উদ্ভট ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রী এক নীতির কথা বলেন, আর ওষুধ প্রশাসন আরেক কথা বলে।’

গণস্বাস্থ্যের কিটের বিষয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। পরিচয় দিয়ে তাকে যোগাযোগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মেসেজও করা হয়। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

মহাপরিচালককে না পেয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. সালাউদ্দিনের সঙ্গে যোগযোগ করা হয়। তার কাছে গণস্বাস্থ্যের কিটের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি এখন আর কিছুই বলতে পারব না। এটা ডিজি মহোদয়ই বলতে পারবেন। এটা তো অনেক পুরোনো ব্যাপার।’

‘এটা (গণস্বাস্থ্যের কিট নিবন্ধন) না পাওয়ার কারণ অনেকবার পত্রিকায় এসেছে। অনেকবারই বলা হয়েছে। আমি এ ব্যাপার বলার এনটাইটেল (যথোপযুক্ত ব্যক্তি) নই। এটা ডিজি মহোদয়…।’

  • সর্বশেষ - আলোচিত খবর